পরমারাধ্য গুরুদেব
শ্রীমৎ আচার্য বিবেকানন্দ গোস্বামীর
স্বহস্তে লিখিত অমৃত বাণীর অবিকৃত ছাপানো গ্রন্থ
মৃত্যু
আচার্য বিবেকানন্দ গোস্বামী
এম.এ. (ট্রিপল),
সপ্ততীর্থ
প্রাক্তন সহযোগী
অধ্যাপক (দর্শন), বরগুনা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বরগুনা।
প্রতিষ্ঠাতা: বাংলাদেশ সেবাশ্রম।
অনবরত পরিবর্তনশীল নশ্বর সংসারে সকলই অনিশ্চিত, কেবল মৃত্যুই
নিশ্চিত। ছায়া যেমন বস্তুর অনুগামী, মৃত্যুও তেমনি দেহীর সঙ্গী। গীতায় ভগবানের
উক্তি-
“জাতস্য হি ধ্রুবো
মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ”
জন্মগ্রহণ করলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। মৃত্যুর হাত হতে পরিত্রাণ
লাভের উপায় নাই। মৃত্যু কাহাকও উপেক্ষা করে না। অগণ্য গণ্য পরিবেষ্টিত লোক
সংহারকারী বিবিধ অস্ত্র-শাস্ত্র সমন্বিত সম্রাট হতে বৃক্ষতলবাসী ছিন্নকন্তা-সম্বল
ভিখারী পর্যন্ত সকলকেই একদিন মৃত্যু মুখে পতিত হতে হবে।
কর্মক্ষেত্রে সংসারের কোন কার্য্যের বা কোন বিষয়ের স্থিরতা ও
নিশ্চয়তা নাই; কিন্তু মৃত্যু নিশ্চয়ই হবে মৃত্যুর মত অবশ্যম্ভাবী নিশ্চয়তা আর
কিছুতেই নাই। প্রাত:কালে সূর্য্যোদয় হলে সূর্য্যাস্ত যেমন অবশ্যম্ভাবী; দিবা
অবসানে রাত্রি যেমন নিত্য সংঘটিত হতেছে, তেমনি জন্মগ্রহণ করলে মৃত্যু হবেই।
শারীরিক বলবীর্য, ধন-জপ, সম্পদ, মান, গৌরব, প্রতাপ ও প্রভূত্ব প্রভৃতি সর্ব গর্ব
মৃত্যুর নিকট খর্ব্ব হবে। শাস্ত্রে পাওয়া যায় যে, সত্যযুগ হতে কলিযুগ পর্যন্ত ৭ জন
মৃত্যুকে উপেক্ষা করে অমর হয়েছেন। যথা-“অশ্বত্থমা, বলির্ব্যাস, হনুমানঞ্চ, বিভীষণ,
কৃপে পরশুরাম, সপ্তাতে চিরজীবিন:”। অর্থাৎ অশ্বত্থমা, পাতালব্ধ বলিরাজ, ব্যাসদেব,
হনুমান, বিভীষণ, কৃপাচার্য্য- এই ৭ জন চিরজীবি বলে শাস্ত্রে উক্ত আছে এবং জন্মতিথি
পূজার সময় এই ৭ নামের উল্লেখ করা হয়।
এই ৭ জন ব্যতীত এই মর জগতে অমর কেহই নাই। অবশ্য যোগ সাধন ও
অন্যান্য ক্রিয়ানুষ্ঠান দ্বারা দীর্ঘজীবন লাভ করা যায় সত্য: কিন্তু জন্মগ্রহণ করলে
আজ হোক কিংবা দশ বৎসর পরেই হোক সকলেরই সেই শমন ভবনে যেতে হবে। মৃত্যু অনিবার্য্য
এবং সকলেই যেমন মৃত্যুর অধীন, তেমনি মৃত্যুর অবধারিত কাল নেই। মায়া মমতাহীন
নির্দ্দয় মৃত্যুর সময় অসময় নাই, কালাকাল বিচার নাই। মৃত্যু কাহারও সুবিধা-অসুবিধা
দেখে না, কারো উপরোধ অনুরোধ শুনে না, কারো ভালো-মন্দ চিন্তা করে না-কারো দু:খ কষ্ট
বুঝে না। মৃত্যু কারো নিকট পূজা অর্চ্চনা চাহেনা- কারো তোষামোদে কি কোন প্রকার
প্রলোভনে ভুলে না, কারো রূপ-গুণ, ধন, মান গৌরবের প্রতি ছকপাত করে না।
মৃত্যু বয়সের অপেক্ষা করে না, সাংসারিক কার্য্য সম্পন্নের
অসম্পূর্ণতা ভাবে না, কখন কোন অজ্ঞাত প্রদেশ হতে অলক্ষিতে এসে আপন করে লয়। ঐ দেখ
বিধবা যুবতী ৪/৫ টি শিশু লয়ে দুর্দ্দশায় দিশেহারা নিরাশা নীরে নিমগ্ন এবং লন্ড ভন্ড
হয়ে চক্ষুর জলে বক্ষ ভাসাচ্ছে আর নিজের করে শিরে চপেটাঘাত করে অদৃষ্টকে ধিক্কার
দিতেছে; কখনও বা বিধির বিধানের নিন্দা করছে। আহা! ওদের আশা ভরসার আকাক্ষা যুবকের
যৌবনান্ত না হতে জীবনান্ত হয়েছে। যে মৃত্যু শিশুদিগের মুখের দিকে না চেয়ে ওদের
অন্নদাতা জন্মদাতাকে গ্রহণ করেছে উপযুক্ত আহার অভাবে শিশুগণ শিঘ্র হয়তো সেই
মৃত্যুর।
(২)
পারলৌকিক
অধীন হবে; এরূপ প্রত্যহ দিনরাত কত কত মর্মান্তিক ঘটনা
দৃষ্টিপথে পতিত হতেছে কিন্তু নির্দ্দয় মৃত্যুর হৃদয় দয়ার সঞ্চার হয় না। মৃত্যু
শোক, তাপ, সময় অসময় কিছুই গ্রাহ্য করে না, কোন বাধা বিঘ্ন মানে না। কখন কোন ভাবে
এসে গ্রাস করবে তার নিশ্চয়তা নাই; কিন্তু একদিন সকলকেই যে মৃত্যুর অধীন হতে হবে তাতে
বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। প্রকৃতপক্ষে জগতে এমন কিছুই নাই ও মানুষের এমন কোন সাধ্য
নাই যা দ্বারা ভীষণ বিভীষিকাময় মৃত্যুর গতিরোধ করা যায়। অতএব যখন একদিন মরিতেই
হইবে তখন কতোদিন পরে জীবনসঙ্গিনী সহধর্ম্মিনী ও প্রাণাধিক পুত্র-কন্যা ছেড়ে
ধনজনপূর্ণ সুখের সংসার ফেলে শমন ভবনে যেতে হবে, তা কার না জানতে ইচ্ছা হয়?
এক বৎসর কি ছয়মাস পরে মৃত্যু হবে তা জানতে পারলে সাংসারিক ও
বৈষয়িক কার্য্যের বিশেষ সুবিধা হয় এবং নাবালক পুত্র কন্যাদের ভরণপোষন ও
রক্ষণাবেক্ষনের একটা সুবন্দোবস্ত করা যায়। আর কতদিন পরে সুখের সংসারের সমস্ত ছেড়ে
যেতে হবে জানতে পারলে ঐহিক সকল কার্য্যের সুবিধা হোক না হোক কিন্তু আর একটি
কার্য্যের বিশেষ সুবিধা হয়, সেই কার্য্যে এই-
পারলৌকিক
নানাবিধ ভোগবিলাস বিজড়িত অনন্ত সুখ দুঃখ পূর্ণ সংসারে লোক সকল
ইহলোকে কেহ আনন্দে ভাসছে, কেহ দুঃখে ডুবছে, কেহ নানা সুখভোগ করছে, কেহ দুঃখ
দুর্দ্দশায় কষ্ট পাচ্ছে, কেহ হয়তো ধনীর গৃহে জন্মগ্রহণ করে আজীবন আমোদ-প্রমোদে,
সুখস্বচ্ছন্দে দিন কাটাচ্ছে। কেহ হয়তো বৃক্ষতলবাসী হয়ে দ্বারে দ্বারে ভ্রমন করে
ভিক্ষা দ্বারা উদর পূরণ করছে। কারো হয়তো দুধে চিনি, আবার কারো হয়তো শাকের উপর নুন
জোটে না। এরূপ নানা বৈষম্য নিত্য চক্ষে প্রত্যক্ষ হচ্ছে। এ বৈষম্যের কারণ কি?
সুখে-সম্পদে, রোগে-শোকে সকলেই ভাগ্য বা অদৃষ্টের দোহাই দিতেছে। আবার কেহ বা পরম
দয়াবান ভগবানের অবিচার বলে সমস্ত দোষ ভগবানের স্কন্ধে চাপাচ্ছে।
কিন্তু বাস্তবিক কি ভগবানের দোষ? ভগবান কি কাউকে সুখী কাউকে
দুঃখী করেছে? কখনই নহে; অনন্ত করুনানিদান ন্যায়বান পক্ষপাত পরিশূন্য। তিনি রাজা
প্রজা ধনী গরীব সুখী পন্ডিত মূর্খ সকলকেই সমান চক্ষে দেখে সমান স্নেহ বিতরণ করে
থাকেন। তাঁর নিকট আত্মপর নাই। তাঁর দুষ্টিতে বৈষম্য নাই, পক্ষপাত নাই তবে জগতে
নিয়ম বৈষম্যের কারণ কি? কারণ মানুষের স্বীয় অদৃষ্ট অনুসারে সুখ-দুঃখ ভোগ করে থাকে।
কিন্তু অদৃষ্ট ত দেখা যায় না, এই অদৃষ্টপূর্ণ অদৃষ্ট কি? অদৃষ্ট আর কিছুই নয়- “নিজ
নিজ কর্মফল”।
(৩)
মানুষের ভাল ও মন্দ যে কর্ম্ম, সেই কর্মানুরূপ শুভদৃষ্টি বা
দুরাদৃষ্টরূপে ভালমন্দ ফল প্রদান করে থাকে। কর্ম্ম দ্বিবিধ- পাপ ও পূণ্য। এই
কর্ম্মক্ষেত্রে সংসারে মানুষ সম্পূর্ণরূপে কর্মের অধীন। গত জন্মে মানুষ যেমন
কর্ম্ম করেছে কর্তমান জন্মে সেই কর্মই অদৃষ্টরূপে ফল প্রদান করছে। আবার বর্তমান
দেহে যেরূপ কর্ম করবে; পর জন্মে তদনুরূপ ফলভোগ করবে। অবশ্য যারা হিন্দুধর্ম ও শান্ত্রে
অবিশ্বাসী এবং পরকাল পুনর্জন্ম স্বীকার করে না তাদের এ ভাল লাগবে না, তারা এ অংশ
বাদ দিয়ে শেষাংশে পাঠ করবেন ও পরীক্ষায় বুঝবে।
গুরুবাক্য ও যৌগিক পন্থা
যারা হিন্দু এবং হিন্দু ধর্ম্ম ও প্রাচীন মুনিঋষিগণের লিখিত
শাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা বিশ্বাস করেন তাদের জন্য বলতেছি যে, মানবের কর্ম্মই
অদৃষ্টরূপে প্রতিভাত হয়ে ফল প্রদান করে থাকে।
শুভকর্ম করলে শুভাদৃষ্ট হয় অর্থাৎ ফলপ্রদান করে আর মন্দকর্ম ও
অধর্ম করলে দুরাদৃষ্টরূপে দুঃখদুর্দ্দশা ভোগ করতে হয়। পূর্বে বলেছি মৃত্যু যেমন
অবশ্যম্ভাবী তেমনি কর্মফল ভোগও অবশ্যম্ভাবী। অনন্ত জ্ঞানভার মহামতি ভীষ্ম
বলেছেন-“মা ভুক্ত ক্ষিয়তে কর্ম্ম কল্পকোটি শতৈরপি, অবশ্যমেব ভোক্তব্যঃ কৃতকর্ম্ম
শুভাশুভং”। (মহাভারত) ভাল ও মন্দ যে কর্ম্ম করবে, তার ফলভোগ অবশ্য করতে হবে।
অবশ্য মন্দ ফলভোগ করতে কেহ চায় না কিন্তু কর্ম তোমার কর্ম তো
তোমাকে ছাড়বে না। তুমি স্বর্গেই থাক আর মর্ত্তেই থাক যেখানে যাবে তোমার কৃতকর্ম
তোমার নিকট যেয়ে ফলভোগ করাবে। তুমি যদি ভালকর্ম করে থাক তবে অবশ্যই ভাল ফলভোগ
করবে; আর মন্দ কর্ম, পাপ ও অকর্মজনক কার্য্য করে থাক তদনুরূপ মন্দ ফল অবশ্যই ভোগ
করবে সন্দেহ নাই। পুরান তন্ত্র প্রভৃতি শান্ত্রে কর্মফল ভোগের কথা আছে। যারা
শিক্ষার দোষে, সংসর্গের গুনে, বয়সের চাপল্যে পরকাল ও কর্মগুনে জন্ম, কর্ম, অদৃষ্ট
স্বীকার করে না তাদেরও পরিনামে একদিন স্বীকার করতে হবে এর প্রত্যক্ষ প্রমানও অনেক
দেখেছি। শাস্ত্রে ব্যক্ত আছে যে, “কর্মের দরূনই জীবের জন্ম হয়, কর্মের দরূনই জীব
মৃত্যুপথে নিপতিত হয়”।
জলৌমকর ন্যায় জীব উত্তর দেহকে অবলম্বন করে পূর্ব দেহ পরিত্যাগ
করে থাকে। কিন্তু এই উত্তর দেহ পাওয়ার কারণও জীবের কর্ম। পূর্ব জন্মে যেরূপ কর্ম্ম
করেছে মৃত্যুর পর তদনুরূপ দেহ ও গুন, ধনমান, বিদ্যা-বুদ্ধি ও অদৃষ্ট পেয়ে সুখ-দুঃখ
ভোগ করে থাকে। এই-ই বিধির বিধি, এই-ই শাস্ত্রে লিখিত নিশ্চিত সত্য। শাস্ত্রে কথিত
আছে যে, মানুষ ধর্ম্ম কর্ম্ম দ্বারা সুখ ভোগ করে, কর্ম্মের দ্বারাই দুঃখ ভোগ করে।
কর্ম্ম বলেই তারা জন্মগ্রহন করে, কর্ম দ্বারা শরীর ধারণ করে থাকে এবং কর্ম্মের
বলেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। যথা-
“কর্মনা সুখমন্নতি
দুঃখ মন্নতি কর্মনা।
জায়ন্তে চ প্রলীয়ন্তে
বর্ত্ততে কর্মনা বশায়ৎ”।।
(৪)
এক ব্যক্তি রোগে, শোকে, দুঃখে ও দারিদ্রে কষ্টভোগ করছে। সে
ব্যক্তি এ জীবনে কোন পাপ কার্য্য করে নাই। পরদোষ দর্শনে আমরা খুবপটু; সুতরাং
অনেকেই বলবে লোকটি অনেক পাপ করেছে, এখন কর্মের ফলভোগ করছে- এটাই না হয় স্বীকার
করতেম কিন্তু ৫ম বর্ষীয় বালক বালিকা কঠিক রোগে দীর্ঘকাল কষ্ট পাচ্ছে; কেহ বা
বিকলাঙ্গ হয়ে অকর্ম্মন্য শরীর বহন করছে। ওরা তো এ জন্মে কোন পাপ কর্ম করে নাই, পাপ-পুন্য
বোঝে নাই সুতরাং এ জন্মে পাপ পুন্য কিছুই নাই তবে কেন ওরা বিষম দুঃখ কষ্ট ভোগ
করছে। এসব দেখে কোন নির্বোধ বলবে যে ভগবান ওকে কষ্ট দিতেছেন।
কিন্তু ধার্মিক ও জ্ঞানবান ব্যক্তির একথা কর্ণগোচর হলে তিনি
বলবেন যে-“ভগবানের কোন দোষ নাই” ওর জন্মান্তরীন কর্ম্ম ফলে ও এ জন্মে দুর্দ্দশা
ভোগ করছে, বাস্তবিক এ কথা সত্য। পূর্বেই বলেছি ভগবান সর্বজীবে সমান দয়া করেন এবং
সমদৃষ্টিতে সকলকে দেখে থাকেন। সুতরাং ওরা যে পূর্ব জন্মের নীজকৃত কর্মফল ভোগ করছে,
এ জন্মের দুঃখ দুর্দ্দশা তার সত্যতা প্রতিপন্ন করছে। অতএব কর্ম্মানুযায়ী ফলভোগ
অবশ্যই করতে হবে।
যারা মনুষ্যকুলে জন্মগ্রহন করে ধনোপার্জন, পরিবার পোষন ও
ভোগবিলাসে দিনযাপন করাই মানব জীবনের চরমোন্নতি এবং একমাত্র কর্ত্তব্য স্থির করে
নিশ্চিত, যারা ধনসংগ্রহ যশ মান প্রভৃতির আশায় সর্বদা ব্যতিব্যস্ত, যারা ধর্মের ধার
ধারে না, ভ্রমেও ভগবানের নাম স্মরন করে না এদের সকলেরই পরজন্মের সুখের পথ কন্টকাকীর্ন।
পূর্বজন্মের সৎকর্মের ফলে এজন্মে ধনী হয়েছে কিন্তু এ জন্মে ধর্ম্মে রত থেকে অর্থের
সদ্ব্যবহার ও সাধন ভজনাদি না করলে পরজন্মে দুঃখ দরিদ্রতা অবশ্যই হবে। অসীম
ধীশক্তিশালী তীক্ষ্নবুদ্ধি পন্ডিত চানক্য বলেছেন, “কর্ম দোষণ দরিদ্রতা”।
সত্য কথা। যারা পূর্ব জন্মে ধর্মার্থে পুন্যার্থে অর্থের
সদ্ব্যবহার করে নাই, তারাই বর্ত্তমান জন্মে দরিদ্রতার ভীষন আবর্তে পড়ে হাবুডুবু
খাচ্ছে। যারা বর্ত্তমান জন্মে আয় ও অবস্থানুরূপ অর্থের সদ্ব্যবহার এবং সাধন ভজন
করছে না তারা আগতজন্মে দরিদ্ররূপে নানা দুঃখে দুর্দ্দশা ভোগ অথবা পশ্বাদি যোনিতে
জন্মপ্রাপ্ত হবে। “অর্থ কপুর চরনাং অভ্যাসেহ কপুয়া যোনিম। পদ্যেয়নর শ্বযোনি বা
শূকর যোনিং বা চন্ডাল যোনিং বেতি”। অর্থাৎ বিধি নিষিদ্ধ শাস্ত্রে বিরুদ্ধ পাপ
কর্মানুষ্ঠান দ্বারা শীঘ্র নীচ যোনি কিংবা শূকর, কুকুর প্রভৃতি পশুযোনি অথবা গীতায়
ভগবান বলেছেন-
তানহং দ্বিষতঃ ক্রুবান…………..যোনিষু।
নিত্য অশুভ কর্ম্মানুষ্ঠান রত ও দ্বেষী, ক্রুর, নরাধম প্রভৃতি
অসুর প্রকৃতি মানবগণকে আমি জন্ম মুত্যু মার্গে নিপতিত করে অতি ক্রুর ব্যাঘ্র
সর্পাদি যোনিতে ভ্রমন্ করাই।
(৫)
অতএব যারা ধন উপার্জ্জন ও বিলাসে জীবন যাপন করছে, ধর্ম কর্ম, সাধন
ও ভজন করার অবসর পান নাই তারা যদি জানতে পারেন যে আর এক বৎসর কি ছয়মাস পরে
স্ত্রী-পুত্রাদি ও সাধের ধন ও বিষয় আশায় ভবসংসারে সবছেড়ে শূন্য হস্তে নিঃসম্বল
অবস্থায় অসহায় একা চলে যেতে হবে, তাহলে বিষয়ভিববাদির জন্য সুবন্দোবস্ত এবং
পুন্যাদি এবং পুন্যাদি কর্ম্মের দ্বারা পরলোকেই ইষ্টসাধন করতে পারবেন। সকল শ্রেনীর
লোক যেমন ইহজীবনের সাংসারীক স্বার্থ নিয়ে তৎপর তেমনি ইহ-পরলোকের মংগল ও সুখের জন্য
সকলেরই স্ব-স্ব জাতীয় ধর্মানুষ্ঠান ও সাধন ভজন করা কর্ত্তব্য।
সকলপ্রাণী অপেক্ষা মনুষ্য শ্রেষ্ঠ। এই বিশ্বসংসারে জলে স্থলে
আশি লক্ষ যোনিতে ভ্রমন করে পরে মনুষ্য যোনি লাভ হয়। পশুপক্ষী আদি হয়ে কত জন্ম
কোথায় থাকতে হয় তা শাস্ত্রে নির্দ্দিষ্ট আছে-
“স্থাবরং বিংশ লক্ষন্ত, জলজা নব লক্ষকাঃ, কৃমিজা রুদ্র
লক্ষান্ত
পাশবো দশ লক্ষকাঃ; অন্তজা ত্রিংশ লক্ষান্ত চতুর্লক্ষান্ত
মানবঃ”।
জলে ও স্থলে, পশুপাখী, কীটপতঙ্গাদি নানারূপ আশিলক্ষ বার
জন্মগ্রহন করে শেষে মানবদেহে চার লক্ষবার জন্মগ্রহন করতে হয়। মানবদেহ ধারন করে
পুন্যপ্রভাবে ভারতবর্ষে জন্মেগ্রহন করে থাকে। কারন ভারতবর্ষের ন্যায় পুন্যপদ স্থান
পৃথিবীর আর কোথাও নাই। প্রাণীগণ বহু জন্মের পর কদাচিৎ পুণ্যভূমি ভারতে মানবজন্ম
লাভ করে থাকে। শাস্ত্রে উক্ত আছে যে, ভারতবাসীরা দেবগণ হইতেও শ্রেষ্ঠ এবং ধন্য,
কারণ তাদের জন্মভূমি স্বর্গ ও মোক্ষ উভয় লাভের হেতু স্বর্গপদ পুন্যকর্ম্ম ক্ষয় হলে
আবার কিভাবে সমুদয় ইন্দ্রিয় যুক্ত হয়ে ভারতে জন্মগ্রহন করবো দেবতারাও এই কামনা
করেন। প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষ পারলৌকিক কার্য্যানুষ্ঠানে সর্বশ্রেষ্ঠ। মর্ত্তলোকের
মধ্যে এই ভারতবর্ষে বসেই মুনি ঋষিরা তপস্যা করে থাকেন। পরলোকের আদর ও উপকারার্থ যে
কিচু দান কার্য্য তাও এস্থানে সম্পাদিত হয়ে থাকে। ভারতবাসীরা পৃথিবীর মধ্যে
ভারতভূমিকে কর্মভূমি বলে ইহ-পারলৌকিক মঙ্গল উদ্দেশ্যে ধর্ম কার্য্যানুষ্ঠান করে
থাকে।
এহেন দেব-প্রার্থীর ভারতবর্ষে জন্মগ্রহন করে যারা ধর্মচিন্তা
ও পারলৌকিক মংগল উদ্দেশ্যে কার্য্যানুষ্ঠান না করে তারা অতি মন্দভাগ্য এবং পাপের
মূর্ত্তি। সাংসারিক ও বৈষয়িক কার্য্যে নিয়ত ব্যাপৃত থেকেও সকলেরই ধর্মানুষ্ঠান ও
উপাসনা করা কর্ত্তব্য। যারা উপার্জ্জন, ধন সংরক্ষন ও ধনের পরিমাণ বৃদ্ধি করন
চিন্তায় সতত নিযুক্ত এবং যারা ২৪ ঘন্টাকাল সংসার নিয়ে ব্যাপৃত; যারা এই মর জগতে
অমর ভেবে চিরকালের জন্য কায়েমী পাট্রনিয়ে আসছেন বলে মনে করে সতত স্বার্থ সাধনে রত
থেকে ধর্ম- কর্ম্ম করতে ও ভগবানের আরাধনা করতে সময় পান নাই অথবা তৎপ্রবৃত্তি যাদের
মনের মধ্যে স্থান পায় নাই তারা যদি জানতে পারেন যে মৃত্যু ভীষণ বদন ব্যাদান করে
নৃত্য করছে, আর ছয়মাস কি এক বৎসারান্তে ইহসংসারের ধন সম্পদ প্রিয়পরিজনাদি ত্যাগ
করে যেতে হবে তাহলে আর কিছু হোক না হোক ঐ অল্প সময়ের মধ্যেও পরকালের মঙ্গলজনক অনেক
কার্য্য করতে পারেন।
(৬)
মাতার কর্ত্তব্য
গর্ভাবস্থায়
স্ত্রীলেকের কিভাবে থাকলে সু-সন্তান লাভ হয়ঃ-
১। গর্ভ হলে উপবাস, মৈথুন, মল-মূত্রাদির বেগধারণ, রাত্রি
জাগরণ, শোকাদি পরিত্যাগ করবে।
২। গর্ভাবস্থায় বায়ুজনক আহার ও বায়ুবৃদ্ধিকর অধিক করিলে
গর্ভস্থ সন্তান কুজোঁ, অন্ধ, জড় বা বামন হয়।
৩। পিত্তবর্দ্ধক আহার ও আচরণ অধিক পরিমাণে করিলে গর্ভস্থ
সন্তান পিঙ্গলবর্ণ হয়।
৪। শ্লেষ্মাজনক অর্থাৎ কফ বৃদ্ধিকর আহার ও হিমাদি শৈত্যসেবা
অধিক পরিমাণে করলে সন্তান শ্বেতরোগগ্রস্থ অথবা পান্ডুবর্ণ হয়ে থাকে। শাস্ত্রে আছে
যে পিতা- মাতার অনাচার ও উভয়ের কর্মদোষে বায়ু, পিত্ত, শ্লেষ্মার প্রকোপ হলে,
গর্ভবিকার প্রাপ্ত হয় এবং সেই বিকৃতগর্ভের সন্তানও বিকৃত হয়ে সর্প, বৃশ্চিক,
কুষ্মান্ড প্রভৃতির ন্যায় হয়ে থাকে।
গর্ভবতী নারীর চতুর্থ মাস হতে যে যে অভিলাষ হয় তা পূর্ণ না
হলে ও গর্ভস্থ স্থান কুব্জ, কুনি, খঞ্চু, বামন ও বিকৃতচক্ষু ও অন্ধ হয়। এ জন্য
গর্ভাবস্থায় যা যা ভোগ করতে কিংবা দর্শন করতে অভিলাষ/ইচ্ছা হয়, গর্ভপীড়া জন্মাবার
আশংকা নিবারানার্থ সেই সকল পূর্ণ করা কর্ত্তব্য।
গর্ভবতী নারীর যে যে বস্তু আহার করতে ইচ্ছা হয়, তা আহার না
করলে সন্তাদের কোন না কোন দোষ জন্মে থাকে। স্ত্রীজাতি স্বভাবত: লজ্জাশীলা, বিশেষত
আহারের অভিলাষ কোন মতেই ব্যক্ত করতে পারে না; এ জন্য গভীর জ্ঞানসম্পন্ন প্রাচীন
মহাত্মারা ‘সাধভক্ষণ’ করার রীতি প্রচলন করেছিলেন ও গর্ভাবস্থায় ইচ্ছানুরূপ আহার
করতে না পারলে সন্তানের বিশেষ অনিষ্ট হবার সম্ভাবনা বলে ‘ষড়রস’ সমন্বিত বিবিধ
আহার্য্য বস্তুদ্বারা ‘সাধ’ দিবার রীতি প্রচলিত আছে। রমনীর গর্ভাবস্থায় যে যে
ইন্দ্রিয়ের অভিলাষ পূর্ণ না হয়, গর্ভস্থ সন্তানেরও সেই সেই ইন্দ্রিয়ের পীড়া জন্মে;
অতএব গর্ভাবস্থায় কেবল আহার বলে নয়, যা যা অভিলাষ হয়, সুসন্তান ইচ্ছা করলে তা
পূর্ণ করা সর্বতোভাবে কর্ত্তব্য।
চতুর্থমাসে গর্ভস্থ সন্তানের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রকাশ
পায়, হৃদয় জন্মে ও চৈতন্য প্রকাশ পায়। এই সময় গর্ভস্থ সন্তানের নানাবিধ ভোগ করার
অভিলাষ হয়ে থাকে এবং রমনীদিগের দুই হৃদয় হয়। গর্ভবতীর তাৎকালিক অভিলাষকে দৌহৃদ্য
বলে, সেই অভিলাষ পূর্ণ না হলে গর্ভস্থ সন্তান নানারূপ দোষযুক্ত হয়। এজন্য
গর্ভাবস্থায় স্ত্রীলোকদিগের অভিলষিত সামগ্রী দেওয়া বিশেষ কর্ত্তব্য।
চতুর্থ মাসে সন্তানের যেরূপ ভোগের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি হয়; সঙ্গে
সঙ্গে মাতারও ভোগের স্পৃহা বৃদ্ধি পায়। সেজন্য ৫ মাসে ‘পঞ্চামৃত’ দিবার ব্যবস্থা
করেছেন। আজকাল অনেকে হয়তো মনে করেন, এ একটা ‘স্ত্রী-আচার’ মাত্র কিন্তু ইহা
অবহেলার বিষয় নয়। কারণ উক্ত অভিলাষের নিবৃত্তি না হয়ে সন্তানের মহা অনিষ্ট হয়।
চতুর্থ মাস হতে ঐরূপ দৌহৃদ্য সময় গর্ভবতী নারীর যদি রাজদর্শনে
অভিলাষ হয়, তবে সেই গর্ভের সন্তান মহাভাগ্যবান ও ধনবান হয়।
অলংকার অথবা রেশমী বস্ত্রের অভিলাষ হয়ে সন্তান মনোহর ও অলংকার
প্রিয় হয়।
(৭)
দেবতা ও প্রতিমা দর্শনে অভিলাষ হলে সন্তান অতি সভ্য ও সৎ হয়।
সর্পাদি ও হিংস্র জন্তুর দর্শনের অভিলাষ হলে সন্তান হিংসাশীল হয়। মৃগমাংশ ভক্ষণের
অভিলাষ হলে সন্তান দ্রুতগামী ও বিক্রমশীল হয়। বরাহ মাংসের অভিলাষ হলে সন্তান
পরাক্রমশালী ও নিদ্রাশীল হয়। মহিষ মাংসের অভিলাষ হলে সন্তান রক্তাক্ষ, লোমযুক্ত ও
পরাক্রমশালী হয়। এতদ্ব্যতীত অন্য যে জন্তুর মাংসের অভিলাষ হলে সন্তান স্বভাব ও
আচরণ হয়ে থাকে। অথবা অন্য যে প্রকৃতির বন্তু দর্শন ও গীতবাদ্যাদি শ্রবনের অভিলাষ
জন্মে সন্তানও সেই প্রকৃতির হয়। গর্ভবতী নারী হিংসা, দ্বেষ, মিথ্যা ভাষণাদি যেরূপে
অন্যায় আচরণ করুক না কেন, গর্ভস্থ সন্তানও তার সেই গুণ প্রাপ্ত হবে। গর্ভাবস্থায়
যত ধর্ম্ম ও সৎ চিন্তা করবে সন্তান ততই ধার্মিক ও সুখী হবে। গর্ভাবস্থায়
দিবানিদ্রা একেবারেই ভাল নয়। গর্ভবতী নারী দিবানিদ্রা পরিত্যাগ করবে। দিবানিদ্রা
হেতু শরীর রসস্থ হয় বলে গর্ভস্থ সন্তানেরও শ্লেষনা বৃদ্ধি হয় এবং প্রসব সময়েও কষ্ট
হয়ে থাকে।
প্রসবে কষ্ট হইবার কারণ
যে সমস্ত স্ত্রীলোক গর্ভ হলে কাজকর্ম করে না, কেবল শুয়ে, বসে
ও নভেল পড়ে সময় কাটায়, সে সকল রমনীদের প্রসব সময়ে অত্যন্ত কষ্ট হয়। সাধারণত: বড়
ঘরের মেয়েদেরই প্রসব হতে বেশী কষ্ট হয় ও তাদের মধ্যে মারাও বেশী যায়। গরীবের ঘরের
মেয়েরা সাংসারীক পরিশ্রমের কার্য্য করে বলেই তাদের প্রসবে কোন কষ্ট হয় না এবং মেয়ে
ডাক্তারও ডাকতে হয় না। বিলাতের বড় ঘরের মেয়েদের সুখে প্রসব হওয়ার জন্য ‘কসরত’ করার
নানারূপ প্রণালী আছে। উহা তত সুবিধাজনক নয়, কারণ সকল স্ত্রীলোকের শরীরের গঠনও এক
নয়, মনের গতিও এক নয়, সেজন্য অস্বাভাবিক উপায়ের চেয়ে স্বাভাবিক সাংসারিক কার্য্য
করা সকল রকমেই ভাল। আমাদের দেশের মেয়েদের রান্না-বাড়া, ঘর উঠান ঝাড়ু দেওয়া, জল
তোলা, বাটনা বাটা, কুটনা কুটা, এইসব কার্য্য করলেই প্রসব সময়ে আর কষ্ট পেতে হয় না।
সুখে ও সহজে প্রসব হওয়ার এরূপ উপায় আর নাই।
প্রসূতির খাদ্যের ব্যবস্থা
সন্তান জন্মাবার দিন হতে ৬ দিন পর্যন্ত প্রসূতিকে শুধু ঘি ও
কালজিরা বাটা দিয়া ভাত ১ বেলা দিবে, বৈকালে দুধ-রুটি বা সাবু দিবে। ৬ দিন পর্যন্ত
ডাল, তরকারী, মাছ প্রভৃতি কিছুই খেতে দিবে না। যদি একান্তপক্ষে উহা খেতে কষ্ট বোধ
হয় বা না পারে তবে আলু-পটোল, কাঁচাকলা ভাতে দিয়ে খাবে। ক্রমান্বয়ে ডাল-মাছ দেয়া
যেতে পারে। কিন্তু ১ মাস পর্যন্ত প্রত্যহ কালজিরা বাটা ও ঘি কতক খাওয়ান বিশেষ
উচিত। কারণ প্রসূতির কাঁচা নাড়ীতে গুরুপাক জিনিস খেলে অনেক রকম রোগই হতে পারে
সূতিকা রোগ হবার ইহা প্রধান কারণ।
সূতিকা রোগ না হইবার উপায়
প্রসূতিকে পূর্বলিখিত ব্যবস্থামত খাদ্য দিবে ও ১ মাস পর্যন্ত
প্রসূতির গৃহে অগ্নি সর্বদা রেখে অগ্নি সেবা করতে দিবে। শিশুকেও কিছুদিন পর্যন্ত
অগ্নিতে নেকড়া গরম করে সমস্ত শরীরে সেক দিতে হয়, তাতে শিশুর কফের দোষ নষ্ট হয়ে
থাকে। এই অগ্নি সেক
(৮)
ও বিধিমত আহার করলে কোন প্রসূতিরই সূতিকা রোগ হবে না।
পাড়াগাঁয়ে এ ব্যবস্থা অধিকাংশ গৃহেই আছে। কিন্তু বর্তমানে যে সব লোক এসব ব্যবস্থা
মত চলে না, দেখা যায় তাদের মধ্যেই সূতিকা রোগ বেশী হয়ে থাকে।
প্রসূতিকে মাটিতে শুইতে দিবে। ঘুমন্তকালে অনেকেই ঠান্ডা লাগার
ভয়ে খাট-চৌকিতে শুইতে দিয়ে থাকে; কিন্তু খাট-চৌকিতে শরীরের রস টানার ক্ষমতা নাই,
বরঞ্চ বৃদ্ধিই হয়ে থাকে। যে সব লোক খাট-চৌকিতে শুয়ে থাকে তাদেরই বাতের ব্যারাম
বেশী হয়। মাটির একটা রস টানার আশ্চর্য্য ক্ষমতা আছে পরীক্ষা করলে বুঝতে পারা যায়।
যোগী সন্ন্যাসীদের শরীরে রস বৃদ্ধি না হবার জন্য মাটিতে শোয়ার ব্যবস্থা আছে। মনে
করবে না যে, তারা খাট-চৌকি কোথায় পাবে, সেজন্য ভূমি শয্যায় শুয়ে থাকে। কিন্তু তা
নয়। ভূমি শয্যাই শরীরের পক্ষে উত্তম।
সূতিকা রোগ না হইবার কারণ
সূতিকা রোগ হবার প্রধান কারণ বিরুদ্ধ ভোজন। প্রসবের পরই ডাল,
মাছ, তরকারি ও অন্যান্য গুরুপাক জিনিস ভোজন করায় তা হজম হয় না বলে শরীরে রসে পূর্ণ
হয়। সেই রস পরিপাক করার শক্তি প্রসূতির কাঁচা নাড়ীতে থাকে না ও অপরিপক্ক রস
ক্রমান্বয়ে বায়ুকে আশ্রয় করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, তাতেই জ্বর হয়, হজম শক্তি কমে যায়,
পেটে নানারূপ অসুখ হয়, মাথা ঘোরে, শেষে নানারূপ উপসর্গ উপস্থিত হয়। সূতিকা রোগ
একবার হলে আর সহজে যেতে চায় না।
অনেকেই আজকাল প্রসবের পরই প্রসূতিকে ব্রান্ডি খাওয়ায়ে থাকেন।
ব্রান্ডিতে শরীর একটু গরম করে সত্য কিন্তু শরীরের রস টানার শক্তি ব্রান্ডিতে নাই।
বরঞ্চ ব্রান্ডি খাওয়ার দরুন অনেক ক্ষেত্রে নাড়ীতে ক্ষত হয়ে থাকে। তার চেয়ে অল্প
মাত্রায় ২/১ দিন একটু একটু আফিং খঅইতে দিলে ভাল হয়। প্রসূতির প্রসবের পর একটা
বেদনা হয়, তাকে ভেদাল ব্যাথা বলে, আফিং খাওয়ালে সেই বেদনারও বিশেষ উপশম হয়ে থাকে।
আমরা ইংরেজদের সাথে তুলনা করতে যাই কিন্তু তাদের শীত প্রধান
দেশে যে বিধি উপকারী আমাদের গরম দেশে তা উপযুক্ত নয়। বিশেষত: তারা যেরূপভাবে থাকে,
চলাফেরা ও আহারাদি করে ও স্বাস্থ্যের জন্য যেরূপ যত্ন নেয়-ভারতে কয়টি লোক আছে
সেরূপভাবে খেতে ও থাকতে পারে? অতএব এদেশের ব্যবস্থাই আমাদের উপকারী।
সুপুত্র লাভের উপায়
রমনীগণের ঋতুর পর ষোড়শ দিন পর্যন্ত গর্ভধারণযোগ্য ক্ষমতা
থাকে, ইহাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু সুসন্তানকামী ও সুস্থ শরীরাভিলাষী ব্যক্তি ঋতুর
১ম চারি দিবস ১১শ ও ১৩শ দিবস একেবারেই বর্জন করবে। এই ৬ দিন বাদে বাকি ১০ দিনের
মধ্যে উত্তরোত্তর যত বেশী দিন গত করে গর্ভাধান করবে সন্তান ততই ভাল হবে। অর্থ্যাৎ
সন্তান বলবান ও ধনবান, সৌভাগ্যশালী ও আয়ুষ্মান হবে।
রাত্রির ১ম
প্রহরে গর্ভাধান হলে
সেই গর্ভস্থ সন্তান অল্পায়ু হয়ে
থাকে।
” ২য়
” ” ”
” পুত্র দরিদ্র ও কন্যা
দুর্ভাগিনী হয়।
” ৩য়
” ” ”
” কুমতিবিশিষ্ট ও পরকিংকর হয়ে
জীবন যাপন করে কন্যা দুষ্টা ও পতিঘাতিনী হয় এবং বার্দ্ধক্যে
পরকিংকরী হয়ে দারূণ দরিদ্রতা ভোগ করে। কেবল ৪র্থ প্রহরে গর্ভাধান করলে পুত্র বা
কন্যা সর্ববিষয়ে ভাল হয়। কিন্তু ৪র্থ প্রহর বলে ভোর বেলা বা শেষ রাত্রে কেহ
গর্ভাধান করবে না। ৩য় প্রহর অতীত হলে ৪র্থ প্রহরের প্রারম্ভে গর্ভাধান করতে হবে।
এছাড়া পঞ্চপর্বে গর্ভাধান নিষিদ্ধ। যেমন-অমাবস্যা, পূর্ণিমা, চতুর্দ্দশী, অষ্টমী ও
সংক্রান্তি। কেননা পঞ্চপর্ব দিনে পুরুষ ও স্ত্রীজাতীর শক্র ও শোনিত দূষিত হয়ে থাকে
পরন্তু স্ত্রীসংসর্গ করলে শরীর নীরোগ ও দীর্ঘজীবি হয় না। সূতিকা রোগ
নিবারণ-সামুকের হলুদ গেতলা বিছানা ত্যাগের পূর্বে খাবে যে খাওয়াবে সে দূরের।
(৯)
প্রাতঃকালে শয্যা হতে উঠিবার নিয়ম
প্রত্যহ
প্রাতঃকালে নিদ্রাভংগ হলে শয্যা হতে উঠার সময় যে নাসিকায় শ্বাস বহে সেই দিকের হস্ত
দ্বারা সেই দিকের মুখ স্পর্শ করে উঠলে বাঞ্ছিত ফল লাভ হয়। সেই দিন কোন হানি কিংবা
বিপদ হবে না, এমনকি কন্টক পর্যন্ত বিদ্ধ হবার আশংকা নেই। প্রত্যহ প্রাতঃকালে
নিদ্রাভংগ হলে শয্যা হতে নামবার সময় হাত দুখানি চিৎ করে সম্মুখে রেখে, হস্তস্থিত
মোটামুটি রেখাগুলি প্রতি দৃষ্টি করবেন। পরে যে নাকে শ্বাস হচ্ছে সেই দিকের হাত
দ্বারা মুখের সেই পার্শ্ব স্পর্শ করবেন, তৎপর শয্যা হতে মৃত্তিকায় পা দিবার সময় যে
নাকে শ্বাস বহে সেই দিকের পা অগ্রে বাড়ায়ে শ্বাস ভিতরে প্রবেশকালে শয্যা হতে
নামবেন। প্রত্যহ এ নিয়ম পালন করতে ভুলবেন না। অতি আশ্চর্য্য ফল পাবেন। পরীক্ষা
করলে বুঝতে পারবেন।
যাত্রা করার নিয়ম
১। পূর্ব ও
উত্তর দিকে দক্ষিণ নাকে এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে বাম নাকে শ্বাস প্রবাহিত সময়
যাবে। এর অন্যথা হলে কার্য্যসিদ্ধি হবে না এবং শত্রুভয় থাকবে ও নানারূপ বিঘ্ন হবার
সম্ভাবনা থাকে। এই নিয়মে ও নিয়মের বিপরীতে কারো সাথে দেখা করতে কিংবা যে কোন
কার্য্যে গেলেই এর আশ্চর্য্য ফল দেখতে পাওয়া যায়।
২। যাত্রাকালে
দক্ষিণ নাসিকায় বায়ুবহন হলে দক্ষিণ চরণ ও বাম নাসিকায় শ্বাস বহন হলে বাম পদ অগ্রে
বাড়ায়ে নি:শ্বাস গ্রহনের সময় স্বগ্রহ হতে বহির্গত হবে।
৩। শনি ও
শক্রবারে ৭ বার, রবি, সোম, মঙ্গল ও বুধবারে ১১ বার এবং বৃহস্পতিবারে অর্দ্ধবার
মাটিতে পদক্ষেপ করে বহির্গত হলে কার্য্যসিদ্ধি হবে।
শনিবারে
বাম নাসায় শ্বাস বহনকালে বামপদ অগ্রে বাড়ায়ে যেতে হবে। অগ্রে বাম হাত দ্বারা
পার্শ্ব স্পর্শ করে প্রথমে বাম পদ বাড়ায়ে ৭ পদ চলে দাঁড়াবে এবং কিছুক্ষণ দাঁড়ায়ে
পরে আবার ঐ বামপদ অগ্রে বাড়ায়ে চলে যাবে এরূপে যে বারে যে কয়বা ক্ষেপনের বিধি আছে
সেই বারে সেই কয়পদ গমন করে কিছুক্ষণ দাঁড়াবে। পরে প্রথমে বাম কি দক্ষিণ যে পদ
বাড়ায়েছিলে আবার সেইপদ অগ্রে বাড়ায়ে যথেচ্ছা চলে যাবে।
শীঘ্র
যাত্রা করার সময় ঐ নিয়মে অর্থাৎ বাম নাসায় শ্বাস বহনকালে ৪ পদ এবং দক্ষিণ নাসায়
শ্বাস বহনকালে পঞ্চপদ গমন করে দাঁড়াবে। কিছুক্ষণ দাঁড়ায়ে পরে প্রথমে যে পদ অগ্রে
বাড়ায়ে যাত্রা করেছ আবার সেই পদ অগ্রে বাড়ায়ে যথেচ্ছা চলে যাবে।
বার বিশেষে
যে পদক্ষেপনের যে নিয়ম বলা হয়েছে অর্থাৎ যে বারে যতবার পদক্ষেপন করতে হবে তা বাম ও
দক্ষিণ নাসায় বায়ূ বহনকালে একই নিয়ম হবে।
৪। কোন
স্থানে শীঘ্র গমন করতে হলে, শত্রুর সাথে বিবাদের জন্য যেতে হলে অথবা হানির কারণ
উপস্থিত হলে তথন নাকে শ্বাস বহন হলে সেই দিকের অঙ্গে হাত স্পর্শ করবে এবং বাম
শ্বাস বহন হলে ৪ বার এবং দক্ষিণ নাকে শ্বাস বহনকালে ৫ বার মাটিতে পদক্ষেপ করে
বহির্গত হবে-এরূপ গমনই শ্রেয়। এতে হানি বা কলহ কিছুই হবে না। এমনকি একটা কণ্টকও
ফুটিবে না। সকল প্রকার বিপদ বিহীন হয়ে গৃহে প্রত্যাগত হবে।
হাত মুখ ধুইবার নিয়ম
প্রাতে হাত-মুখ ধোঁয়ার সময় প্রথমে মুখ পূর্ণ করে জল নিয়ে ২৫
বার চোখে জলের ঝাপটা দিবে, ৪/৬ বার জল দিয়েই ১ বার করে জলের দ্বারা কপাল ধুতে হয়।
পরে মুখের জল ফেলে দাঁত মাজতে হয় ও যত ইচ্ছা চোখ মুখ ধৌত করা যায়। কিন্তু প্রথমত:
মুখে জল রেখে চোখে জল দিতে হবে।
দুবেলা আহারের পর অথবা যে কোন সময় মুখ ধৌত করা হয়, প্রথমে
মুখভরা জল নিয়ে ৮/৯ বার জলের ঝাপটা চোখে দিবে ও কপাল ধুবে। এরূপ নিয়মে চোখ ঠান্ডা
থাকে, চোখে অসুখ হয় না, মাথা ধরার উপকার হয়, চশমা লাগে না।
তবে প্রত্যেকেই ধাতু নির্মিত জিভছোলা ব্যবহার করলে শ্লেষ্মার
দোষ নষ্ট হয়।
(১০)
প্রাতে ঘুম ভাঙ্গলে কি কার্য্য করতে হয়
প্রাতে যখন নিদ্রাভংগ হয় তখন চিৎ হয়ে হাত-পা টান করে আবার
তখনই হাত-পা গুটায়ে এনে কনুয়ের দ্বারা দুই দিকের পাঁজরে (যকৃৎ ও প্লীহার স্থানে)
চাপ দিয়ে আবার হাত পা টান করে ছেঁড়ে দিতে হয়। এরূপ ২/৪ বার করার পর ৫/৭ বার এপাশ
ওপাশ ঘাড়পোড়া দিতে হয়, তৎপর ২/১ মিনিট উপুড়ে হয়ে শুয়ে থেকে শয্যা হতে উঠতে হয়।
এরূপ করলে বাহ্যের বেগ সহজে আসবে, প্লীহা লিভারের কার্য্য ভাল হবে। কোন দিনই
প্লীহা ও লিভারের অসুখ হবে না। প্লীহা ও যকৃতের অসুখ থাকলে ক্রমান্বয়ে বিনা ঔষধেই
কমে যাবে। সপ্তাহে ২/৩ দিন করলেই হবে। কিন্তু প্রত্যহ ঘুম ভাঙ্গলে কিছু সময় উপুড়
হয়ে থাকতে হয়। (ক) প্রাত:কালে শয্যা হতে উঠে, আহারের পর ডান হতের বৃদ্ধাঙ্গুলির
নিম্নভাগ দিয়ে কপাল ২/৩ বার ঘসে দিতে হয়। একে যোগশাস্ত্রে কপাল ভাতি বলে। এতে
কফাস্রিত বায়ু ও শ্লেষ্মার দোষ নষ্ট হয়। (খ) প্রাত:কালে ঘুম হতে উঠে ও সন্ধ্যার
সময় তর্জ্জনী দ্বারা কানের মধ্যে ঘসে দিতে হয়। যোগশাস্ত্রে একে কর্ণভাতি বলে। এতে
যাবতীয় কর্ণরোগ ভাল হয় ও কোনদিন কর্ণরোগ হয় না।
আহার ও স্নান
ব্রহ্মমুহূর্তে নতুবা ৯ টার পর। দক্ষিণ নাকে শ্বাসের সময় আহার
করতে হয়। বাম হাঁটু তুলে বাম বগলে চাপ দিয়ে আহার করতে বসতে, অম্ল ও অজীর্ণের
(ডিসপেপসিরা) রোগের জন্য উপকারী। আহারান্তে ১০/১৫ মিনিট বীরাসনে বসে হাড়ের অথবা
মহিষের শৃঙ্গের চিরুনী দিয়ে বেশ করিয়া সমস্ত মাথা আচড়াইবে। কষ্ট হলে ক্রমে ক্রমে
অভ্যাস করবে। এতে বাত ও অর্শ্বের ব্যারাম আরোগ্য হয়। চুল ওঠেনা, পাকে না,
চুলবৃদ্ধি পায় ও মাথা ঠান্ডা থাকে।
শয়ন
পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে মাথা রেখে বাম নাকে শ্বাস প্রবাহের সময়
শুইতে হয়। ২/১ মিনিট চিৎ হয়ে তারপর বাম কাত হয়ে শুয়ে নাভিতে মন রাখবে। এতে
অতিসত্বর ঘুম আসবে এবং সুনিদ্রা হবে, স্বপ্নদোষ হবে না, ক্রমে এমন হবে যে, রাত্রে
স্বপ্ন দেখবে না।
নিষিদ্ধ আহার
১। মাছ,
মাংস, দুধ একপাত্রে বসে খাওয়া উচিত নয়। তবে ১ঘন্টা পরে দুধ খাওয়া যায় এবং দধি খেতে
বাধা নাই। মাছ-দুধ একত্রে খেলে বাতের ব্যারাম ও অন্যান্য ব্যাধি হয়।
২। রাত্রিতে
দধি খাবে না, খেলে শ্লেষ্মা বৃদ্ধি হয়, ১ মাসের কমে দধি হজম হয় না। দিনে দধি খেলে
লবন ও জল মিশায়ে খাবে।
৩।
চৈত্রমাসে গুড় খেলে কৃমি বৃদ্ধি হয়। এতে কলেরা পেটের অসুখ আমাশয় প্রভৃতি রোগ হওয়ার
সম্ভাবনা। তবে চিনি মিছরী কম খাওয়া যায়।
৪।
চৈত্র-বৈশাখ-কার্ত্তিক মাসে মাছ খাওয়া ভাল নয়। চৈত্র-বৈশাখে পুকুরের মাছে বসন্ত
রোগ হয়। কার্ত্তিকে মাছে শ্লেষ্মা হয় এতে শীতকালে মুখে ক্ষত হওয়া ও ঠোট ফাটার
কারণ। তবে একান্ত প্রবৃত্তি দমন করতে না পারলে নদীর মাছ খেতে পারা যায়।
৫। কার্ত্তিক
মাসে যত কম খাইলে চলে তত কম খাবে। কারন অতিরিক্ত খেলে বায়ু, পিত্ত, কফ বৃদ্ধি হয়
এছাড়া পেটের অসুখ হবেই।
৬। পৌষ মাস
টানের মাস বিধায় বেশী খাওয়া যায়।
৭
রবি-বৃহস্পবিার মাছ ও মুসুড়ির ডাল খাওয়া উচিত নয়। রবিবারে মুসুড়ির ডাল খেলে
বহুমূত্র জন্মে, শরীর অত্যন্ত গরম হয়, মাথার উত্তেজনা ওবং আরও অনেক রকম ব্যাধি হয়।
(১১)
৮। অমাবস্যা,
পূর্ণিমা ও একাদশীতে ভাত না খাওয়া ভাল। উপবাস না করতে পারলে রুটি ও সাবু খাওয়া
মন্দ নয়। এসব তিথিতে পৃথিবী রসাক্রান্ত হয়। এজন্য আমাদের দেহেও রসাক্রান্ত
শ্লেষ্মার আধিক্য হয়। অমাবস্যার একাদশী হতে অমাবস্যা এবং পূর্ণিমার একাদশী হতে
পূর্ণিমা পর্য্যন্ত খারাপ-মহাষ্টামী, রামনবমী, শিবচতুর্দ্দশী, জন্মাষ্টমী,
দোলপূর্ণিমায় উপবাস।
৯। অতিরিক্ত
ভোজন নিষেধ। এত অলসতা, দুর্বলতা বৃদ্ধি পেয়ে রোগ হয়।
১০।
বুধ-সোম ব্যতীত ক্ষৌরকর্ম নিষেধ/ একাদশী-পূর্ণিমা, অমাবস্যা সংক্রান্তি পর্বদিন
বাদ দেওয়া উচিত। তাছাড়া রাত্রি এবং জন্মবারও।
১১।
সূর্য্য-চন্দ্র ও যেদিন হতে বায়ু প্রবাহিত হয় সেদিকে মুখ করে বাহ্য প্রস্রাব
নিষেধ। সূর্য্যের দিক মুখ করে বাহ্য প্রস্রাব করলে শির:পীড়া এবং চন্দ্র ও বায়ু
প্রবাহিত দিকে বাহ্য প্রস্রাব করলে শুক্রগত পীড়া জন্মে।
১২। দাঁড়ায়ে
প্রস্রাব করলে ইন্দ্রিয়ের শক্তি শিথিল হয়, মেরুদন্ডের দুর্বলতা জন্মে প্রস্রাব
সম্পূর্ণ নি:শেষে বের হয় না, ইহা বহুমুত্রের ১টি কারণ। কাছা খুলে প্রস্রাব না করলে
প্রস্রাব সরলভাবে বের হয় না। প্রস্রাব করে জল না নিলে অনেক রূপ দূষিত ব্যাধি হতে
পারে।
১৩।
পূর্বদিকের ও সম্মুখ বায়ু সেবন করলে দুষ্ট ব্রণাদি রোগ হয়।
১৪। সম্মুখ
বায়ু সেবনে শির:পীড়া হয় এবং পৃষ্ঠ বায়ু সেবন করতে হয়।
১৫। ভাদ্র,
আশ্বিন ও কার্তিক তা ভিন্ন শিশিরে বা রৌদ্রে কোথাও যেতে হলে কান দুটি রুমাল বা
চাদর দ্বারা বেঁধে নিবে। এজন্য পাগড়ি।
১৬। প্রস্রাব,
বাহ ও হাচিঁর বেগ ধারণ করবে না-এতে কঠিন রোগ হয়।
১৭।
সূর্য্যগ্রহন ও চন্দ্রগ্রহণ:- গ্রহনের পর ৭ দিবস পর্যন্ত শরীর খারাপ থাকে,
বায়ু-পিত্ত ও কফ কুপিত হয়, গ্রহনের সময় প্র্রস্রাব-বাহ্য খাওয়া দাওয়া নিষেধ।
কলেরা/ বসন্ত রোগ হয় না
শ্বেত
কন্টিকারীর আধ তোলা মূল ২টা গোলমরিচ একত্রে পিষে সকালে খালি পেটে একদিন খাবেন।
পাথরকুচি গাছের ১টি পাতা ২৫টি গোলমরিচ দিয়ে পিষে রোগীকে খাওয়াবে, না কমলে ২ ঘন্টা
পর ঐ মাত্রায় আবার কলেরা রোগীকে খাওয়াবে।
জ্বর-সব প্রকার
নিছিন্দার
মূল হাতে বেঁধে দিবে সকল প্রকার জ্বর সারে।
সাদা
অপরাজিতা গাছের মূল যতক্ষণ স্বাভাবিক গন্ধ থাকে ঘ্রাণ নিবে।
কাগজি
লেবুর পাতার ঘ্রাণ সকালে ও বৈকালে নিবে।
কালাজ্বর
কলেকটি
শ্বেত অপরাজিতা ফুলের পাতা অথবা বকফুলের পাতা নেকড়ার মধ্যে পুটুলি করে জ্বরের
পালার দিন সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিবে। উক্ত পাতার রস ২ তোলা খেলেও হয়।
সুখে প্রসব
বাসক গাছের
উত্তর দিকের মূলের ১টি শিকড় ৭ গাছ লম্বা সুতা দিয়ে প্রসূতির কোমরে বাঁধবে কিন্তু
সাবধান সন্তান দেখা দিলেই উহা খুলে ফেলবে।
রোগ আরোগ্য
অর্দ্ধঘন্টা
পদ্মাসনে নীচের পাটি দাঁতের গোঁড়ায় জিহ্বাগ্র রাখবে। অথবা ললাটোপরি পূর্ণচন্দ্র
সদৃশ জ্যোতি ধ্যান করবে।
রক্ত পরিস্কার
প্রত্যহ
সকালে বৈকালে ৫/৭ মিনিট কারককুর মত ওষ্ঠদ্বয় করে কার পাতাম নিবে ও নাক দিয়া ছাড়বে।
সন্ধ্যাকালে ও রাত্রিতে গাছতলায় কিংবা গাছের সম্মুখে বসে বায়ু টানবে না। আহারান্তে
৩/৪ ঘন্টার মধ্যে এটা করা নিষেধ।
ঘি
১৭ বছরের
পূর্বে ও ৫০ বৎসরের উর্দ্ধে ঘি খাওয়া উচিত নয়। ৪০ বৎসর পর্যন্ত খাওয়া ভাল। ১৭
বছরের পূর্বে দুধ-মাখন এবং ৫০ বয়সের উর্দ্ধে দুধ খাবে।
(১২)
নিষিদ্ধ আহার/ কার্য্য
১. তাল কলা একসঙ্গে
খেলে ক্রিমি হয়। কলা-মিষ্টিতেও তাই।
২. খালিপেটে তাল ও
আহারের পর বেল খাবে না।
৩. পিঁয়াজ দিয়া ডিম
পাক করে খাবে না। ৪. মধু-মুড়ি-ঘি খেয়ে জল খাবে না। ভরা পেটে ঘি খাবে না। ৫. ৮/৯ টা
(সকাল) পর্যন্ত পেট ভরা ভাত খাবে না। ৬. নরম ভাত বালক-বালিকা ও বৃদ্ধদের পক্ষে ভাল
কিন্তু যুবকের শক্ত ভাত খাবে। ৭. সন্ধি সময় (দিন যায় রাত্রি আসে) আহার নিষিদ্ধ।
১. চৌকি বা চেয়ারে বসে পা নাড়ান নিষেধ।
২. আহারের পর অন্তত: ১০/১৫ মিনিট বিশ্রামের পর গমনা-গমন।
৩. উপর দিকে বা এদিক-ওদিক চেয়ে পথচলা নিষেধ।
৪. পূন্যকার্য্য করে বললে পুণ্য ক্ষয় এবং পাপ করে বললে পাপ
ক্ষয় হয়। পাপের জন্য অনুতাপ আসলে পাপ ব্যাধি আরোগ্য হয়।
৫. কেহ কারো প্রতি অন্যায় করলে অভিসম্পাতে আয়ুক্ষয় ও অন্যান্য
ক্ষতি হয় কিন্তু একটি লোক দশজনের ক্ষতি করছে সেক্ষেত্রে বললে তার ক্ষয় হয়।
৬. পরনিন্দা ও পরশ্রীকাতরতা পরিত্যাগ করবে/ নাম ধরে কাউকে ঘুম
হতে ডাকতে নাই।
৭. শুভকাজ ৩ কান করতে নাই বা বাকিও রাখতে নাই।
স্ত্রী সংসর্গ বিষয়ে উপদেশ
পুরুষের দক্ষিণ নাসায় শ্বাস বহন কালে এবং স্ত্রীর বাম নাসায়
শ্বাস বহনকালে স্ত্রীসংসর্গ করতে হয়। নচেৎ পুরুষের বাম ও স্ত্রীর দক্ষিণ শ্বাসে
সঙ্গম হলে অল্প সময় স্থায়ী হয়। পুরুষের বীর্য্য অগ্রে পতন হয়, তাতে স্ত্রীদের সংগম
আকাঙ্ক্ষা মিটে না, তদ্দরুন স্ত্রীদের প্রদরাদি নানারূপ রোগ হয়ে থাকে/ বর্তমানে
এসব স্ত্রীরোগের প্রাদুর্ভাব একারণেই হয়ে থাকে।
স্ত্রী সংসর্গের পর পুরুষ দক্ষিণ কাৎ হয়ে শয়ন করবে অর্থাৎ
পুরুষের বামশ্বাস প্রবাহিত হবে/ স্ত্রী বাম কাত হয়ে শুইবে তাতে দক্ষিণ শ্বাস
প্রবাহিত হবে। অর্থাৎ স্ত্রীর দক্ষিণশ্বাস প্রবাহিত করাতে হবে। তাতে সঙ্গমজনিত
শরীরের ক্ষয়, দুর্বলতা নিবারণ হবে ও শরীরে শান্তি রোধ হবে।
সংসারে রোগ হবার কারণ
১. মিথ্যা অসুখের ভান করা।
২. খাদ্যের বিভিন্নতা অর্থাৎ পার্সিয়ালটি খাওয়া।
৩. পাকের কার্য্যে অবহেলা।
৪. পাক করিতে যেয়ে চাখা বা অন্যকে দিয়ে চাখা।
৫. বাসি হাঁড়ি পাতিলে অন্ন পাক।
৬. স্নান না করে বা রাত্রিবাস কাপড় না ছেড়ে অন্ন পাক করা।
অভাব
হওয়ার বিশেষ কয়েকটি কারণ
. জিনিস
অযথা নষ্ট করা।
. মদ-গাঁজা
প্রভৃতি জিনিস ঔষধার্যে ব্যবহার না করে স্ফূর্ত্তির জন্য ব্যবহার করা।
. তাস-পাশা
খেলে সময়ের অপব্যবহার/ তবে শরীর রক্ষার্থে কোনরূপ ব্যায়াম বা খেলাধূলা নয়।
. কোন কাজ
না করে বাজে গল্প করা।
(১৩)
ভাববার বিষয়
একবার ভেবে দেখবেন যে কত পরিশ্রম, কত কষ্ট করে ধন উপার্জন করে
সঞ্চয় করেছেন। আপনি মরে গেলে স্ত্রী পুত্রাদি অর্থের জন্য কষ্ট পাবে না, সুখে
থাকবে এই আশায় অর্থ সংগ্রহ ও ভোগবিলাস করেই জীবন কাটাচ্ছেন। কিন্তু আপনি যখন সেই
অজ্ঞাত প্রদেশে চলে যাবেন, তখন পথ খরচ বলেও একটি পয়সা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন না। স্ত্রী-পুত্রাদি
কেহই তো সঙ্গে যাবে না। সঙ্গে যাবে কেবল আপনার কর্ম এবং কর্মানুযায়ীই ফলপ্রাপ্ত
হবেন। এখানে অধর্ম করে যে সকল পাপ করেছেন, তার জন্য যখন শাস্তি ভোগ করবেন তখন
স্ত্রী-পুত্র, ধন-জন, লোক-লস্কর কারো দ্বারা কোন উপকার পাবেন না। নিজেই কেবল
যন্ত্রণা ভোগ করে চক্ষুর জলে বক্ষ ভাসাবেন। এই যে অধর্মের আশ্রয় করে পরের অনিষ্ট
করে অর্থ উপার্জন ও সঞয় করেছেন, এখন ঐ অর্থ দ্বারা আপনার কোন উপকার হবে না আর অর্থ
সংগ্রহের উদ্দেশ্যে যে অধর্ম করেছেন তার জন্য তীব্র যাতনা ভোগ করবেন। হায়! এমন
সাধের অর্থ তার এক কপর্দ্দকও সঙ্গে যাবে না।
বরং দারিদ্রমান্যায়, প্রভাবাদ বিভবাদপি, ক্ষীনতা
পানতাদেহেপানতা ততু রোগজ বরং দরিদ্র হয়ে দু:খে থাকা ভাল, তথাপি অন্যায় উপায়ে
বিভবশালী হওয়া ভাল নয়। সুতরাং অন্যায় উপায়ে ধন উপার্জ্জন করা অকর্ত্তব্য। হায়! এমন
সাধের অর্থ তার এক কপর্দ্দকও সঙ্গে যাবে না। তাই শাস্ত্রে বলেছেন-
এক এবসুহৃদ্দর্ম্ম
নিধনেহপ্যনুয়াতি যঃ………………………।
অর্থাৎ ধন-মান, বিষয়-আশায়, স্ত্রী-পুত্র, বন্ধু-বান্ধব সকলই
শরীরের সাথে নষ্ট হয়ে যায়। ধর্মই কেবল একমাত্র সুহৃদ, কেননা ধর্ম মৃত্যুর পরেও
আমাদের সঙ্গে গমন করেন।
শাস্ত্রে আরও বলেছে যে, ধনই বল, আর জনই বল পদ্মপত্রের মধ্যে
জলবিন্দুর ন্যায় সকলই চঞ্চল। অতএব ধর্মাচরণ কর। শ্রুতি স্মৃতিতে যে বিহিত ধর্ম
নির্দিষ্ট আছে মনুষ্য যদি তদনুযায়ী কার্য্য করে, তা ইহকালে কীর্তি ও পরকালের অনন্ত
সুখের অধিকারী হয়। এই সুদুর্লভ মানব দেহ ধারণ করে যে ব্যক্তি ধর্ম উপার্জন করতে
পারল না তার জীবন বৃথা এবং সে ব্যক্তি হই পরকালে দু:খ ভোগ করে থাকে/ আদিত্য পুরাণে
ব্যক্ত আছে-
মনুষ্য যং সমাসাদ্য
স্বর্গ মোক্ষপ্রদায়কম্,
দ্বয়োর্নোসাধ্যয়
ত্যেকংস: মুতস্তপ্যতেচিরম্।।
স্বর্গ-মোক্ষ প্রদায়ক মনুষ্য জন্মগ্রহণ করে যে ব্যক্তি দুয়ের
একটিও সাধন না করল, সে মুত্যুর পর দারুণ অনুতাপগ্রস্থ হয়। মহাভারতে আছে-
যস্যতিবর্গ শূন্যস্য
দিনান্যাপয়ন্তি যন্তিচ,
ন লৌহাকার ভস্ত্রের স
সন্নিপন জীবতি।
ধর্ম্মোপার্জন না করে যে ব্যক্তির দিন আসতেছে ও যাইতেছে;
কর্মকারের ভস্মা যেমন বৃথা নি:শ্বাস প্রশ্বাস ফেলে থাকে, সে ব্যক্তিও সেরূপ বৃথা
জীবিত থাকে। মহাভারতে বলেছেন-
“বিদ্যাবিত্তং বপু:
শৌর্য্য, কুলেজন্মনিরোগীতা; সংসারোচ্ছিত্তি হেতুশ্চ ধর্ম্মাদেব প্রবর্ত্ততে”।
বিদ্যা, বিত্ত, দেহ, শৌর্য্য, কুলিন ও শ্রেষ্ঠ বংশে জন্মগ্রহণ
করা, দেহ অরুগ্ন থাকা সংসার বন্ধন হতে মুক্ত হওয়া সকলেই ধর্ম হতে প্রসূত হয়।
ধর্ম উপার্জন করলে ইহ-পরকালে সুখ হয় এবং অধার্মিক লোক দু:খভোগ
করে এতে সন্দেহ নাই। কর্মানুরূপ ফলভোগ যদি না করতে হতো তাহলে সংসারে ধর্ম ও
পুন্যের নামগন্ধও থাকত না। সকলেই পাশব আচরণে ইন্দ্রিয় সুযখ সম্ভোগ ও অসৎ বাসনা
পূর্ণ করতে
থাকত।
(১৪)
এখন কথা এই যে এই ধর্ম কিসে হয়? কলি যুগে
গৃহস্থের পক্ষে দান একমাত্র ধর্ম। ন্যায়ানুমোদিত উপার্জিত অর্থের কিছু অংশ দান
করতে হবে। অর্থাৎ যার যেমন আর্থিক অবস্থা, তিনি তদনুরূপ দান করবেন। তাই বলে তুমি
ধর্মের মস্তকে বজ্রাঘাত ও ন্যায়ের মস্তকে পদাঘাতপূর্বক একজনের সর্বনাশ করে অর্থ
সংগ্রহ করলে কিংবা চাকুরী করতে গিয়ে মনিবের চক্ষে ধূলি দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে
কিঞ্চিৎ দান করলে অথবা সেই অর্থে দশজন লোক খাওয়ালে অর্থাৎ তোমার নিমকহারামী ও
অধর্ম প্রণোদিত ও ভগ্রতার বহির্ভূত অন্যায় উপার্জিত অর্থ দ্বারা দানাদি করলে,
তোমার কোনই উপকার হবে না। ধর্মসংগত ন্যায় উপার্জিত অর্থ সার্থক, তার কিছু অংশ দান
করতে হবে।
যারা বাইরে ধর্মের কৃত্রিম আবরণে আবরিত, ভিতরে
নিত্য বাইরে অধর্মের পৈশাচিক নৃত্য;- এরূপ দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন অনেক লোক দেখেছি যে,
তারা অন্ধ, খোড়া ও দুর্দ্দশাপন্ন বিপন্ন ব্যক্তিকে দান করে না। তারা বলে থাকে ওরা
পাপী। ভগবান যখন ওদেরকে দন্ড দিচ্ছেন তখন আমরা সাহায্য করি কেন? এদেরকে দান বা কোন
প্রকার সাহায্য করলে ভগবানের বিধির বিরুদ্ধাচরণ এবং অপ্রিয় কার্য্য করা হয়। ইহা
কিন্তু বর্তমান যুোগর নব্য শিক্ষিতদের বিবেক বুদ্ধিসম্মত। ও নজীর দেখায়ে অনেকে
মুষ্টিভিক্ষা পর্যন্ত বন্ধ করে বাজে খরচ হতে নিস্কৃতি পেয়েছেন। কিন্তু আধুনিক
বিবেকবাদীগণ নিজের নির্বুদ্ধিতাবশত: অপপরায়ন ঋষি প্রণীত শাস্ত্র অবিশ্বাস করে
প্রত্যব্যয় ভাগী হচ্ছেন। প্রকৃততত্ত্ব অবগত হতে হলে শাস্ত্রের আশ্রয় এবং
শাস্ত্রবাক্য বিশ্বাস ব্যতীত অন্য গতি নাই। যারা ধর্ম কর্ম স্বেচ্ছাচার মত পোষণে
প্রয়াসী এবং শাস্ত্রবাক্যে অবিশ্বাসী যারা শাস্ত্রবাক্য উপেক্ষা করে চঞ্চল বুদ্ধি
কর্তৃক চালিত হয়ে কর্মানুষ্ঠান করে, তারা ইহলোকে সুখ ও পরলোকে উত্তমগতি প্রাপ্ত হয়
না। এই বিষয়ে গীতায় ভগবান বলেছেন-
য:শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য…………গতিম্।১৬
অধ্যায়
যে শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগপূর্বক স্বেচ্ছাচারী
হয়ে কার্য্য করে তার চিত্তশুদ্ধি হয় না; তার ইহলোকে সুখ ও পরলোকে উত্তমগতি লাভ হয়
না- অর্থাৎ তার ইহলোকও নাই পরকালও নাই।
অতএব যারা নিজের স্বেচ্ছাচারী ধর্মমতের অসার
ভিত্তি অবলম্বন করে শাস্ত্র অবহেলা করে দান করতে পরাম্মুখ তাদের ভগবানের এই
মহাবাক্য সর্বদা স্মরণ রাখা কর্তব্য। দয়াতেই ধর্মের অবস্থিতি। লোকের কষ্ট ও
দুর্দ্দশা দেখে যদি তোমার মনে দয়ার উদয় না হয় এবং দান ও সাহায্য করতে প্রবৃত্তি না
হয়; তবে তোমার ধর্ম কোথায়? যার দয়া নাই, তার ধর্ম নাই। মনুষ্যের মন বুদ্ধি প্রভৃতি
অন্ত:করণ সত্ত্ব:, রজ:, তম, এই তিন গুণের দ্বারা গঠিত। সুতরাং তার কার্য্যাকার্য্য
বিচারের শক্তি কোথায়? জীবের বুদ্ধি নিজের সংস্কারানুরূপ গঠিত, একারণ সর্বসংস্কার
বর্জিত তত্ত্বজ্ঞান ঋষিগণের প্রণীত শাস্ত্রানুসারে অন্ধ, খোড়া, দীন, দু:খী ও
তপস্বীদিগকে দান করা কর্তব্য। যে ব্যক্তি পাপের ফলে দন্ডভোগ করতেছে, সে ত
কর্মানুরূপ ফলভোগ করবেই, সে তেমনি ফলভোগ করবে- এ কথা পড়েই আছে, তুমি অপরের দোষগুণ
কর্মাকর্ম বিচার না করে তোমার কর্তব্য তুমি কর। দান গৃহস্থাশ্রমের একটি প্রধান
ধর্ম, তখন তোমার অবস্থানুরূপ দান করে ধর্মানুষ্ঠান কর-
তস্মচ্ছাস্ত্রং
প্রমাণং তে কার্যাকার্য……………কর্তুমিহার্হসি।।
কার্য্যাকার্য্য নিরূপনে শাস্ত্রই তোমার
প্রামাণ। অতএব শাস্ত্রানুসারে নিজের অধিকার মত শাস্ত্রীয় ব্যবস্থা জ্ঞাত হয়ে
কর্তব্য কর্মে রত হও। যুগ বিশেষে লোকে মতিত্ত দেহানুরূপ ধর্ম ও কর্ম নির্দিষ্ট
হয়েছে এবং সকল শাস্ত্র এক বাক্যে বলতেছে কলিকালে দান একমাত্র ধর্ম।
(১৫)
বৃহস্পতি বলেছেন-
অপোধর্ম: কৃতে যুগে
জ্ঞান ত্রেতাযুগে স্মৃতং,
দ্বাপরে চর্বরা:
প্রোক্ত: কলৌদানং দয়াদম:।।
তপস্যা সত্যযুগের; ক্রেতাযুগের ধর্ম জ্ঞান; দ্বাপরের ধর্ম
যজ্ঞ; কলিতে দান ও দয়াই ধর্ম। যম বলেছেন-
যতীনাস্তু
শমোধর্মস্তনাহারো বনৌকসং
দানমেব গৃহস্থানাং
শুশ্রূষা ব্রহ্মচারিনাং।
শম যতিদিগের ধর্ম: অনাহার বনৌকসের ধর্ম; দান গৃহস্থাশ্রমের
ধর্ম; ব্রহ্মচারীদের ধর্ম গুরুসেবা। যাজ্ঞবল্ক্য মুনি বলেছেন-
দাতব্যং প্রাতহং
পাত্রে নিমিত্তেষু বিশেষত:
যাচিতে নাপি দাতব্য:
শ্রদ্ধাপুতস্তুশক্তিত:।
প্রতিদিন শ্রদ্ধাপূতচিত্তে যাচককে দান করবে। মহানির্বান
তন্ত্রে বলেছেন-
কলৌ দান মহেশানি সর্বসিদ্ধিকরং
ভবেৎ।
অর্থাৎ কলিযুগে একমাত্র দানই সমুদয় সিদ্ধির কারণ।
দানং হি সর্ব ব্যসনানি
হস্তি। -যত অমঙ্গল
আছে সবই দানে নষ্ট হয়।
সর্বশাস্ত্রবিদ বেদব্যাস
বলেছেন যে যাচককে আমি গুরু বলে মান্য করি। কারণ যাচক কর্তৃক মনোবল পরিমার্জিত হয়ে
থাকে।
(১৬)
মাস, বৎসর পক্ষানাম আরম্ভ দিন সম্বিকে। চতুর্দ্দশ্যাষ্টমী শুক্লা তবৈবৈকাদশীকুস্থঃ
নিজ জন্ম দিনঞ্চৈব পিতোর্মরণ বাসরঃ। বৈধোৎসব দিনঞ্চৈব পুন্যকাল প্রকীর্তিতা।
(মহানির্বাণ তন্ত্র চমউঃ)
অর্থাৎ মাসের ও বৎসরের আরম্ভ দিন, পক্ষের আরম্ভ
দিন, চতুর্দ্দশী শুক্লপক্ষের অষ্টমী, একাদশী, অমাবস্যা, নিজের জন্মদিন, পিতামাতার
মরণ দিন এবং বিধিহিত উৎসব দিন অর্থাৎ চন্দ্র-সূর্য্যের গ্রহনকাল, পুণ্যকাল এই
সমস্ত দিনও পুন্যতীর্থে দান করা কর্তব্য। কেননা-
পুন্যতীর্তে,
পুন্যতীথৌ গ্রহনে চন্দ্র সূর্য্যেয়ো;
জপদান
প্রকুর্বানং শ্রেয়সাং নিলযো ববেৎ।। (মহানির্বাণ)
পুন্যতিথিতে, পুন্যতীর্থে ও চন্দ্র সূর্য্যের
গ্রহনকালে জপ ও দান করলে গ্রহস্থ ভোজন হবে। শাস্ত্রে দানের সময়াদি বিশদরূপে বর্ণিত
আছে। শাস্ত্রানুমোদিত সময়ে দান করবে, অল্পদানে বেশী ফল পাওয়া যায়। বার তিথি বিশেষে
অক্ষয় হয়। ঐ অক্ষয় দিনে পাপ বা পুন্য যে কাজ করবে, তার ক্ষয় নাই। যথা-
সোমবারেস্ব
প্যনাবস্যা আদিত্যাহেতু সপ্তমে,
চতুর্থ্যহধারকে
বারে অষ্টমী চ বৃহস্পতৌ;
অত্র
সৎ ক্রিয়তে পাপমথবা পুন্য-সঞ্চয়,
ষষ্ঠী
জন্ম সহস্রানি প্রাপ্রোতি হি তদক্ষরম। (জ্যোতিষ বচন)
সোমবারে অমাবস্যা, রবিবারে সপ্তমী, মঙ্গলবারে
চতুর্থী, বৃহস্পতিবারে অষ্টমী হলে সেই দিনটিকে অক্ষয়া বলা যায়। এই অক্ষয়া দিনে পাপ
অথবা পুন্য যে কর্ম করবে ৬০ হাজার জন্মেও তা ক্ষয় হয় না।
উপর্যুক্ত সোম প্রভৃতি চারিবার ঐ সকল তিথির
সহযোগ মধ্যে হয়ে থাকে। পঞ্জিকা দেখলেই জানতে পারা যাবে। অতএব অক্ষয়া দিনে
সামর্থ্যানুসারে কিঞ্চিৎ দান করা এবং জপ পর্বাদি যে কোনরূপ ধর্ম ও পুন্য কর্ম করা
কর্তব্য। দুর্ভাগ্যবশতঃ যদি কেহ না পারেন, তাহলে অক্ষয়া দিনে সর্তকভাবে দিন যাপন
করা উচিত। যেন কোনরূপ অধর্ম ও পাপ কার্য্য অনুষ্ঠিত না হয়। দান দ্রব্যের পরিমান
অপেক্ষা ফলাধিক্য হওয়ার জন্য স্বরোদয় শাস্ত্রে দান করার একটি বিশেষ বিধি আছে। এর
ভাবার্থ এই যে নিঃশ্বাস গ্রহণ সময়ে যা কিছু দান করা যায় সেই দানের ফল কোটি গুন
অধিক হয়। যথা-
শ্বাসে
সকারসংস্থে তু যদ্দানং দীয়তে বুধৈঃ,
তদ্দার্নং
জীবলোকেহস্মিন কোটি গুনং ভবেদ্ধিতৎ।। (স্বরোদয়)
গৃহস্থগণের কর্তব্য, যে মুষ্টি ভিক্ষা অথবা
অর্থ বস্ত্রাদি যা দান করবে তা স্বাভাবিক শ্বাস গ্রহন সময়ে দিবে। এরূপ দান করলে,
দান দ্রব্যের পরিমানাধিক্য লাভ হবে।
এইতো গেল প্রথম উপায়। দ্বিতীয় উপায়- তপস্যা।
(১৭)
তপস্যা
দান যেমন অবশ্য কর্তব্য, তপস্যাও তেমন অবশ্য করতে হবে। যার
দান করার শক্তি আদৌ নাই, অর্থাৎ দীন দরিদ্র নিতান্ত গরীব, এরূপ ব্যক্তি তপস্যা
করলে, দান ধর্ম ব্যতীত সম্পূর্ণ ফল লাভ করবেন। যার যেমন অবস্থা এবং অবস্থানুরূপ যে
পরিমান দান করার শক্তি আছে তাঁর যথাসাধ্য অন্নবস্ত্র, অর্থাদি দানযোগ্য বস্তু দান
এবং শাস্ত্রসম্মত তপস্যা করবেন। মোট কথা দান ও তপস্যা দুই-ই আবশ্যক।
এখন বক্তব্য এই যে তপস্যা বলে কাকে? অনেকেই হয়তো তপস্যার নাম
শুনে শিহরিয়া উঠবেন আর বলবেন সত্যযুগে বায়ু ভক্ষন করে অনাহারে থেকে তপস্যা করত এখন
(কলিযুগ) তা কি হয়? এ কথা প্রায় লোকমুখে শুনতে পাওয়া যায়, তপস্যায় নাম শুনলে লোক
যেমন ভয় পায় বাস্তবিক তপস্যা একটা ভয়ানক জিনিস নহে। যারা অর্থকে সার করে অর্থ
পাওয়ার আশায় কত প্রকার মন্দ কার্য্য করছেন তাদের নিকট তপস্যা ভয়ানক অরুচিকর ও
অতৃপ্তিজনক; ন্তিু তপস্যা দ্বারা অর্থ ও সুখাদি সমস্ত লাভ করা যায় তা আদৌ বুঝেন
না।
বর্তমানে কালের সংঘর্ষনে বিজাতীয় শিক্ষার প্রচলনে আজকাল
অনেকেই শাস্ত্রবাক্য অবহেলা করে নিজের মত অনুসারে তপস্যা বা সাধন করতে প্রয়াসী।
এখন নব্যবাবুর দল নিজের ধর্ম কর্ম জানে না জাতীয় রীতি নীতি মানেন না নিজেরা
শাস্ত্রপাঠ করেন না, সমাজের কোন সমাচার রাখেন না এবং জাতীয় চালচলন ছেড়ে পরের ভাবে
বিভোর হয়েছেন এজন্য বর্তমান সময়ে নানারূপ নিজের কল্পিত মত প্রবর্তক আসুরীক প্রকৃতির
অনেক লোক দেখা যায় কিন্তু নিজের কল্পিত অশাস্ত্রীয় তপস্যা বা সাধনাকারীগণকে স্বয়ং
ভগবান কি বলেছেন, তাহা হিন্দুমাত্রেই সর্বদা স্মরণ রাখা কর্তব্য। ভগবান বলেছেন-
অশাস্ত্রবিহিতং ঘোরং
তপ্যন্তে যে…………..নিশ্চয়ান্। (গীতা-১৭/অ:)
ভগবান শাস্ত্রানুসরন করতে বারং বার উপদেশ দিয়েছেন। অশাস্ত্রীয়
তপস্যা বা সাধন করতে অগবানের নিষেধ। আজকাল নব্যবাবুদের মনগড়া ও খামখেয়ালী উপসনা
কিছুই নহে। জাতীয় ধর্মানুসারে উপাসনা বা তপস্যা করা সকলের কর্তব্য।
আমাদের বেদ, স্মৃতি, তন্ত্র, পুরাণ সমুদয় শাস্ত্রই তপস্যার
মহিমার বিষয় বলেছেন। মহামতি মনু বলেছেন- দেব এবং মানবের যে সমস্ত সুখশান্তি লাভ
হয়, সকলের মূল তপস্যা। স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল যে কোন স্থানে অবস্থিতি বল, নিরোগী
হওয়া যত গুরুতর হোক না কেন সুতপ্ত তপস্যা কর্তৃক সকল নষ্ট হয়ে যায়। সংসারে যা কিছু
দুস্কর, দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ হোক না তপোবলে সাধিত না হয়, এমন কিছু নাই। দেবতা ও
মানব প্রভৃতি জীব জন্তুগনের সমুদয় দৃষ্টাদৃষ্ট তপোবলে সাধিত হতেছে দেখে দেবতারা
জগৎকে তপোমূল বলেছেন।
(১৮)
তপস্যা আর কিছুই নয়; উপাসনার নাম তপস্যা। কিন্তু উপাসনা করতে
হলে চিত্তের একাগ্রতা চাই। শাস্ত্রে বলেছেন, “উপাসনাহিই চিত্তৈকাগ্রং”। চিত্তের
একাগ্রতা লাভ করাই সমুদয় উপাসনা তপস্যার প্রয়োজন। একাগ্রচিত্ত হলে মানুষের অসাধ্য
কিছুই নাই- একচিত্ত হলে মনুষ্য মনুষ্যত্বের চরমসীমায় উপনীত হয়ে মুক্তিলাভ করতে
পারে। একাথা যোগশাস্ত্রে বিশেষরূপে প্রতিপন্ন আছে। চিত্ত অনুসারে দেবযোনি,
প্রেতযোনি, তির্য্যকযোনি ইত্যাদি প্রস্তুত হয়। এই চিত্তমায়ায় আবৃত হয়ে লোকে
অনন্তকাল সংসার চক্রে ঘুরছে। এই চিত্তশুদ্ধির জন্য হিন্দুশাস্ত্রে কর্ম্মকান্ড
নির্দিষ্ট হয়েছে; শাস্ত্র বিহতি কর্ম্মকান্ড অনুসারে সাধন করলে চিত্তের একাগ্রতা
লাভ হয়ে থাকে। একমাত্র ইষ্টদেবের আরাধনায় তা সম্পাদিত হয়ে থাকে।
অতএব সকলেরই কর্তব্য যে স্ব স্ব বর্ণাশ্রম ধর্ম পালন করে কাম
ক্রোধ লোভাদি রিপুদিগকে স্ববশে বশীভূত রেখে পরদ্রব্য লোভ, পরশ্বাপহরন, পরনিন্দা,
দ্বেষ, হিংসা পরপীড়নাদি না করে সত্য, দয়া, শান্তি, ক্ষামাদি সাধু ইচ্ছায় বশীভূত
হয়ে সর্বতা পরোপকার করবে এবং দেবতা, ব্রাহ্মণ, অতিথি ও পিতামাতা প্রভৃতি গুরুজনের
প্রতি ভক্তি ও তাদের সেবা করবে। আর গুরুপাদিষ্ট ইষ্টমূর্ত্তির প্রতি ও গুরুপাদি
মন্ত্রে ভক্তি বিশ্বাস স্থাপন করে সর্বদা ইষ্টদেবের আরাধনা করবে। আহারের সময়,
বিহারের সময়, শয়নের সময়, ভ্রমনের সময়, কার্য্যের সময়, ধ্যানের সময়, এই সকল
কার্য্যে জীব যখন আপনার কাম ক্রোধ লোভ মোহদিগের নিয়ে আপন ইষ্টদেবে মনপ্রাণের সহিত
আত্মসমর্পন করতে শিখে, যখন ইষ্টদেব হতে আপনাকে আর বিভিন্ন বোধ করতে পারে না, তখন
তপস্যার চরম ফললাভ হয়। তখন সমুদয় সিদ্ধিই আপনা হতে উপস্থিত হয়।
পূর্বে বলেছি শুভ ও অশুভ কর্ম করলে ভাল ও মন্দ ফলভোগ করে
থাকে। অশুভ কর্ম করলে জীবগণ তীব্র যাতনা ভোগকরে আর শুভ কর্মের অনুষ্ঠান করলে সুখ
ভোগ করে; কিন্তু ফলাসক্ত চিত্ত হয়ে শুভ কর্মের অনুষ্ঠান করলে ঐ কর্মে শৃঙ্খলে বদ্ধ
হয়ে ইহলোক ও পরলোক পুনঃ পুনঃ যাতাযাত করতে থাকে। যে পর্য্যন্ত শুভ ও অশুভ উভয় কর্ম
ক্ষয় না হয় সে পর্যন্ত বারংবার আসা যাওয়া ও গর্ভ যাতনা নিবৃত্তি হয় না। লৌহময়
শৃঙ্খল দ্বারা হোক কিংবা স্বর্গময় শৃঙ্খল দ্বারা হোক উভয়বিধ শৃঙ্খল দ্বারা যেমন
বদ্ধ হয় সেরূপ জীব পাপ ও পুন্য উভয়বিধ কর্ম দ্বারা বদ্ধ হয়ে থাকে। সেজন্য জ্ঞানীরা
ফলকামনা না করে সমুদয় সৎকার্য্য করেন, তাতে বন্ধনের কারণ হয় না এবং জন্ম মৃত্যুরূপ
যাতনাও বারং বার ভোগ করতে হয় না। এ কারন ফলকামনা না করে দান, ধ্যান, তপস্যা
প্রভৃতি কর্ম করা কর্তব্য। ভগবান বলেছেন-
অফলাকাঙ্ক্ষিভির্যজ্ঞো…………….
সাত্ত্বিকঃ।। (গীতা
১৭ অ:)
(১৯)
গীতায় কথিত
আছে-
যৎ
করোষি………………বিমুক্তো মামুপৈষ্যসি।। (গীতা ৯/২৭-২৮)
অতএব
ফলাভিসন্ধি মূন্য হয়ে কর্মানুষ্ঠান করা কর্তব্য। ফল কামনা না করে নিত্য নৈমিত্তক
সমস্ত কার্য্য করলে জীবের কবচ বন্ধন হয়ে না, বরঞ্চ ব্রহ্মজ্ঞান হয়ে থাকে আর নিত্য
কর্মের অনুষ্ঠানে ফলাকাঙ্খা করতে হয় না। কারন-
সন্ধ্যামূপাসতে যে তু
সততং সংশিতব্রতাঃ
বিধূত পাপান্তে যান্তি
ব্রহ্মলোক মনায়ম।
ফলকামনা না করেও যখন ফলপ্রাপ্তি নিশ্চয় তখন ফল আকাঙ্খা করে
সংসার পাশে চিরবদ্ধ হয়ে অশেষ দু:খ দুর্গতি ভোগ করি কেন? অতএব ফলাভিসন্ধি শূন্য হয়ে
সকল কর্মের অনুষ্ঠান করা কর্তব্য। এ রূপ নিয়মে কর্মানুষ্ঠান করে মৃত্যু সময়
স্ত্রী, পুত্রাদি, গৃহ, ধন, জন না ভোবে ইষ্টদেবের প্রতি মন সমর্পন করবে।
গীতায়
ভগবান বলেছেন-
যং যং
বাপি……………………ভাবিতঃ।।(গীতা
৮/৬) বাংলা নিজে করবে।
মৃত্যুকালে সংসারের কোন বিষয়ে চিত্ত আসক্ত থাকলে পুনরায়
জন্মগ্রহন করে দুঃখ যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে। কিন্তু ইষ্টদেবের প্রতি চিত্ত সমর্পন
করে মরতে পারলে আর কোন যাতনা ভোগ করতে হয় না। এজন্য মৃত্যুকালে বিষয় বিভবাদি ভুলে
ইষ্টদেবের পাদপদ্মে মনপ্রাণ সমর্পন করা সকলেরই কর্তব্য।
ভগবান
বলেছেন-
অন্তকালে চ মামেব…………….. নাস্ত্যত্র
সংশয়ঃ। (গীতা ৮ম অঃ
বাংলা নিজে করবে।
অনন্য চিত্ত হয়ে ভগবানের চিন্তা করলে জীব তদবস্থা প্রাপ্ত হয়,
সন্দেহ নাই। যেমন- আরসুলা (তেলাপোকা), কাঁচপোকা কর্তৃক ধৃত হয়ে ভয়ে একান্ত চিত্তে
কাঁচপোকার চিন্তা করতে করতে কাঁচ পোকার রূপ প্রাপ্ত হয়। ইহা প্রত্যক্ষ সত্য, এরূপ
অনন্যমনা হয়ে একচিত্ত সহকারে ভগবানের চিন্তা করলে দেবত্বপ্রাপ্ত হয়, সন্দেহ নাই।
অত্যধিক পাপসক্ত ও নিতান্ত দুরাচারী ব্যক্তি একাগ্রচিত্তে ভগবানের ভজন করলে
সর্বপাপ মুক্ত হয়ে পরমগতি লাভ করতে পারে।
অপি চেৎ
সুদুরাচারো……………হি সঃ।
(গীতা ৯/৩০)
অন্যত্র
উল্লেখ আছে-
অতিপাপপ্রসক্তোহপি
ধ্যায়ন্নিমিষচ্যুতং,
ভূয় তপস্বীভবতি ভক্তি
পাবন নমঃ পামরঃ।
প্রয়শ্চিত্তান্য
শেষানি তপঃ কর্মাত্মিকানিধৈ
যানিরতে যামশেষানাং
কৃষ্ণানুস্মরণ পর।।
অত্যধিক পাপাসক্ত ব্যক্তি যদি একাগ্রচিত্তে নিমেষ মাত্রও
ভগবানের ধ্যান করে তা হলে সে ব্যক্তি সর্বপাপমুক্ত হয়ে তপস্বীতুল্য হয়। এরূপ
ব্যক্তিকে দর্শন করলে লোক সকল কৃতার্থ হয়।
(২০)
এবং তিনি মানব মন্ডলীর মধ্যে উপবেশন করলে মানবগণ পবিত্র হয়, ভগবানের
প্রতি একান্ত অনুরাগ এবং ভগবদ্ভক্তি করলে কোনরূপ প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া সর্বপাপ বিনষ্ট
হয়ে পরমসুখের কারণ হয়।
সমস্ত জীবনের মধ্যে সুজ্ঞান হয় নাই মরতে হবে এভাব নাই এবং
মৃত্যুর পর কি দুর্গতি হবে তা মনে হয় নাই কেবল অর্থ অর্থ স্বার্থ স্বার্থ করে
অনর্থক সময় নষ্ট ও জীবন কলুষিত হয়েছে। এখন শেষের সেদিন নিকট অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব
লক্ষণ জেনে সঞ্চিত অর্থের কিছু দান করেন এবং একাগ্রচিত্তে ভগবানের ধ্যান ও স্মরণ
করেন তাহলে সর্বপাপমুক্ত হয়ে পরমগতিম প্রাপ্ত হবে।
আর একটি কথা সকলেই জানেন ধর্মপতি যমরাজের পার্শ্বে চিত্রগুপ্ত
নামে একজন আছে। তাঁর নিকট আমাদের পাপপূন্য ধর্মাধর্ম লেখা রয়েছে। এর ভাবার্থ এই
যে, “চিত্রগুপ্তের অর্থ গুপ্ত চিত্র”। এখানে লোকের চোখে ধূলা দিয়া বেমালুম পাপ করে
হজম করা যায় কিন্তু সেখানে ধর্মরাজের নিকট আমাদের কর্মের গুপ্ত চিত্রে সমস্তই লেখা
রয়েছে। কাজে কাজেই নিস্তার নাই। এ কারণ মৃত্যু নিকট জেনে ধর্ম কার্য্যের অনুষ্ঠান
ও অনন্যচিত্তে ভগবানের ধ্যান করা উচিত বা কর্তব্য।
অতএব সকলেরই পূর্ব লক্ষণগুলি জেনে সাবধান হওয়া আবশ্যক। যারা
যোগী তারা মৃত্যুকে নিকটে জেনে যোগারূঢ় হয়ে প্রাণত্যাগ করতে চেষ্টা করবেন।
মৃত্যুকালে যদি যোগস্মুতি বিলুপ্ত না হয় জন্মান্তরে সিদ্ধি লাভে সমর্থ হবেন। আর
যারা যোগী নহেন। তারা মরনের লক্ষণগুলি দেখে অস্থির না হয়ে এবং যাতনা অনুভব না করে
যাতে ভগবানের প্রতি সতত মন সমর্পন করে থাকতে পারেন, নিয়ত সেই চেষ্টাই করবেন।
ভগবানের ধ্যান ও তার নাম স্মরণ করতে করতে মৃত্যুর সম্মুখীন হলে আর কোন যাতনা ভোগ
করতে হয় না।
শেষ বক্তব্য এই যে, শাস্ত্র অনন্ত, স্থুল বুদ্ধিতে স্থুলচক্ষে
শাস্ত্র বিভিন্ন বলে বোধ হয়; আর সাধনার পথও অনেক প্রকার। শাস্ত্র ও সর্বপ্রকার
সাধনের মুখ্য উদ্দেশ্য এক এবং ফলও এক। এতে বিভিন্নতা কিছুমাত্র নাই। গুরুর কৃপায়
প্রকৃত জ্ঞান লাভ হলে সাধকগণ তা বুঝতে পারেন। যেমন্-
মযিত্বা চতুরো বেদন্
সর্বশাস্ত্রানি বৈব-হি,
সারস্তু যোগিতি:
পিতুন্ডক্রং পিবন্তি পন্ডিতা:।।
অর্থাৎ সর্বশাস্ত্রে সামঞ্জস্য যোগীগণ দেখে বুঝে থাকেন। এজন্য
চারিবেদ ও অন্যান্য শাস্ত্রসকল মন্থন পূর্বক সারভাগ (মাখন) যোগীরা গ্রহন করেন, আর
অসার ভাগ (ঘোল) পন্ডিতগণ গ্রহণ করে থাকেন। বাস্তবিক পন্ডিতগণ শাস্ত্রের অসার ভাগ
গ্রহণ করে বিরাট তর্কজাল বিস্তার পূর্বক বৃথা বচসা করে বেড়ান; শাস্ত্রের সার গ্রহণ
করার শক্তি প্রকৃত যোগী ভিন্ন আর কারো নাই।
শাস্ত্র অনন্ত কিন্তু জীবন অল্পকাল স্থায়ী। এক জীবনে কেহ
শাস্ত্র পড়ে শেষ করতে পারে না। এজন্য সকলকে “ভগবদগীতা” পাঠ করতে অনুরোধ করি। যদিও
গীতার প্রকৃত অর্থ বুঝাবার লোক গৃহস্থলোকে মধ্যে বিরল, তথাপি বারংবার গীতা পাঠ করা
সকলের কর্তব্য। একমাত্র গীতার উপর নির্ভর করলে অন্য কোন শাস্ত্র পড়ার আবশ্যক হয় না
এবং গীতা পড়তে থাকলে গীতা বুঝাবার গুরু আপনা হতেই আসবে।।
-:সমাপ্ত:-
0 comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.