যোগ
শান্ত্রের প্রসিদ্ধ যোগ পদ্ধতিঃ
যোগ শাস্ত্রের জন্য যোগ-শাস্ত্র
একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। এ গ্রন্থের যোগ প্রণালী অনুসারে ধাপে ধাপে অধ্যাবসায়মান
হলে এর প্রভাব নিঃসন্দহে আপনি নিজেই উপলদ্ধি করতে পারবেন। যারা যোগ বা মনের নিবৃত্তি
করতে চান, তাদের জন্য এই প্রণালী খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। এ যোগ পদ্ধতির মাধ্যমে
আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হলে আপনার অভিষ্ট লক্ষ্য পূর্ণ হবেই হবে এবং স্তর বাই স্তর এর
ফলাফলে আপনি নিজেই নিজে উপলদ্ধি করতে পারবেন। যোগ শাস্ত্রে যোগ পদ্ধতির অষ্ট অঙ্গ।
তা নিম্নে বর্ণিত হলঃ
যোগ
শাস্ত্রের যোগ প্রণালী সম্পর্কে আলোকপাতঃ
যোগ সাধনা অত্যন্ত কঠিন সাধনা।
তবে অভ্যাস ও চেষ্টার দ্বারা সবকিছুই সম্ভব। যোগশাস্ত্র মতে, চিত্তবৃত্তির নিরোধই হল যোগ। আর অভ্যাস এবং বৈরাগ্যের দ্বারাই চিত্তবৃত্তির
নিরোধ ঘটে। দৃষ্ট এবং আনুশ্রবিক বিতৃষ্ণা হেতু অর্থাৎ ইহলোক এবং পরলোকের যাবতীয় ভোগ্য
বস্তুর প্রতি যখন মানুষের বিতৃষ্ণা জন্মায় তখন চিত্তে যে নির্লিপ্ত-ভাবের উদয় হয় তখন
তাকে বৈরাগ্য বলে। আর বৈরাগ্যের ফলে চিত্তের
বিষয়মুখিতা দূরীভূত হয়, চিত্ত অন্তর্মুখী হয় এবং আত্মার প্রতি চিত্তের অভিনিবেশ জন্মায়।
আত্মার প্রতি চিত্তের অভিনিবেশকে সুদৃঢ় করার জন্য অভ্যাসের প্রয়োজন। যে যত্নের বা চেষ্টার
দ্বারা চিত্তের একাগ্রতা প্রতিষ্ঠিত হয়, চিত্ত স্থির ও প্রশান্ত হয় তখন তাকে অভ্যাস বলে। এই অভ্যাসের দ্বারা চিত্তের অশুচিতা
দুরীভূত হয়ে জ্ঞানের দীপ্তি বিকেকখ্যাতি পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য যোগশাস্ত্রে অষ্টাঙ্গ
বা আটটি অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ আছে। যথা-
যম,
নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি- এই
আটটি পদ্ধতিই যোগ সাধনের অঙ্গ। এ অষ্টাঙ্গ যোগের অনুষ্ঠানে করলে চিত্তশুদ্ধি হয় এবং
বিকেকখ্যাতি জাগ্রত হয়, যার ফলে সাধকে কৈবল্য
বা মোক্ষ লাভ ঘটে। নিম্নে উপরিউক্ত অষ্টাঙ্গ
মার্গ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলঃ
(ক) যমঃ অহিংসা,
সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ- এই পাঁচটি সাধনাকেই
যম বলা হয়। অহিংসার অর্থ হল কায়িক, বাচনিক (কথা) ও মানসিক ক্রিয়া দ্বারা অপরকে আঘাত
না করা বা অপরকে কোন ভাবেই ব্যথিত না করা। চিন্তায় বা বাক্যে মিথ্যাচারণ না করাই সত্য।
অর্থাৎ যা যথার্থ, মনে ও বাক্যে তা মনে করা ও বলাই সত্য। যে অপ্রিয় সত্য প্রকাশে অপরের
পীড়ার কারণ ঘটে তা প্রকাশ না করই যুক্তিযুক্ত। অল্পভাষিতা অভ্যাস করাই সত্য সাধনের
প্রকৃষ্ট পথ। যা নিজের নয় এমন দ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকাই অস্তেয়। কামবিষয়ক আচরণ
এবং চিন্তা থেকে বিরত থাকাই ব্রহ্মচর্য। কেবলমাত্র প্রাণধারণের উপযুক্ত দ্রব্য গ্রহণই
অপরিগ্রহ। যে ব্যক্তি প্রয়োজনাতিরিক্ত ভোগ্য বস্তুর অধিকারী তা যোগসিদ্ধি হয় না। উল্লিখিত
এই পাঁচপ্রকার যম যদি জাতি, দেশ, কাল ও সময়ের দ্বারা অবিচ্ছিন্ন না হয়, তাহলে সেই সার্বভৌম
যম মহাব্রত বলে গণ্য হয়। যম সাধনের উপর যোগ শাস্ত্রে এতখানি গুরুত্ব আরোপ করার কারণ,
ইন্দ্রিয়াসক্ত, বিষয়ভোগী ও অসংযতচিত্ত ব্যক্তি কখনও যোগ-সাধনার দুর্গম পথে অগ্রসর হতে
পারে না। সেই কারণে প্রয়োজন যম সাধনার দ্বারা চিত্তকে সর্বপ্রথম অশুদ্ধির মালিন্য থেকে
মুক্ত করা।
যম
সাধনের ফলাফলঃ যোগশাস্ত্রমতে, অহিংসা-প্রতিষ্ঠিত যোগীদের সান্নিধ্যে
হিংস্রার তার স্বাভাবিক হিংসাভাব পরিত্যাগ করে। সত্য-প্রতিষ্ঠিত যোগীর কাক্সিদ্ধি
ঘটে, অর্থাৎ তার বাক্যের বলে লোক পুণ্য কর্মের অনুষ্ঠান না করেও তদ্রূপ ফল লাভ করবে।
অস্তেয় বা অচৌর্য প্রতিষ্ঠিত হলে যোগীর কাছে রত্ন বা উত্তম দ্রব্য উপস্থিত হয়। ব্রহ্মচর্য
প্রতিষ্ঠিত হলে যোগীর বীর্য লাভ হয়। অপরিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হলে যোগী অতীত, অনাগত ও বর্তমান
জন্মবৃত্তান্ত জ্ঞাত হয়।
(খ) নিয়মঃ শৌচ, সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বর প্রণিধান-
এই পাঁচটিকে নিয়ম বলে। শরীর ও মনের শুচিতা হল শৌচ। শৌচ হল দু’প্রকার যথা-বাহ্য শৌচ
ও আভ্যন্তরীণ শৌচ। পবিত্র সলিলে স্নান করা, মৃত্তিকা, গোময় ও জলাদির দ্বারা শরীর পরিষ্কার
করা এবং সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করা হল বাহ্যশৌচ। মনকে কুচিন্তা থেকে মুক্ত রাখা এবং
দয়া, মায়া প্রভৃতি উচ্চতর বৃত্তির অনুশীলনে আভ্যন্তরীণ শৌচ। সন্তোষ অর্থে চেষ্টার দ্বার
যেটুকু পাওয়া যায় তাতেই তুষ্ট হওয়া এবং অহেতুক আকাঙ্ক্ষা বর্জন করা। তপঃ হল ব্রতাচার,
অভ্যাসের দ্বারা শরীরকে কষ্টসহিষ্ণু করে তোলা। পরিত্র মন্ত্র জপ এবং উপনিষৎ, গীতা প্রভুতি
মোক্ষশাস্ত্র অধ্যয়ন হল স্বাধ্যায়। ঈশ্বরের ধ্যান এবং ঈশ্বরে সর্ব কর্মফল সমর্পণই হল
ঈশ্বর প্রণিধান।
নিয়ম
সাধনের ফলাফলঃ বাহ্য শৌচ বা শারীরিক শৌচ অভ্যাস করতে করতে নিজ
শরীরের অশুচিতা সম্পর্কে জ্ঞান জন্মায় ও তাতে ঘৃণা জন্মায় এবং পরশরীর সংসর্গের ইচ্ছা
দুরীভূত হয়। ফলে নিবিষ্ট মনে যোগসাধনায় ব্রতী হওয়া সম্ভব হয়। অভ্যন্তর বা মানস শৌচ
প্রতিষ্ঠার ফল হল প্রথমে চিত্তশুদ্ধি। চিত্তশুদ্ধি থেকে উৎপন্ন হয় সৌমনস্য বা মনের
প্রসন্নতা, তার ফলে একাগ্রতা, তা থেকে ইন্দ্রিয় জয় এবং তা ফলে আত্মদর্শনের যোগ্যতা।
সন্তোষ থেকে পরম সুখলাভ ঘটে। তপস্যার দ্বারা চিত্তের অশুদ্ধি ক্ষয় হলে তপোনিষ্ঠ যোগীর
শারীরিক ও ইন্দ্রিয় সম্পর্কীয় সিদ্ধিলাভ হয়, অর্থাৎ ইচ্ছামত শরীর ও ইন্দ্রিয়ের উপর
ক্ষমতা পরিচালনা করার সার্মথ্য জন্মায়। স্বাধ্যায় থেকে ইষ্ট দেবতার সন্দর্শন হয়। ঈশ্বর
প্রণিধান থেকে সমাধি সিদ্ধি হয়, সমাধি সিদ্ধি হয়ে দেহান্তরে, কালান্তরে যা হয়, সবই
জানা যায়।
(গ) আসনঃ যোগাভ্যাস করার জন্য যেভাবে শরীরকে
রাখলে শরীর স্থির থাকে অথচ কোন ক্লেশের কারণ ঘটে না, তাকেই আসন বলে। স্থির ও সুখজনক
অবস্থিতির নামই আসন। শাস্ত্রে আসন অনেক প্রকার আছে। যথা- পদ্মাসন, স্বস্তিকাসন, ভদ্রাসন, দণ্ডাদন,
বীরাসন ইত্যাদি। গুরুর উপদেশ ছাড়া আসন শিক্ষা করা উচিত নয়। গুরুর নির্দেশ ছাড়া
আসন শিক্ষা করতে গেলে উৎকট ব্যাধি হবার সম্ভাবনা আছে। নীরোগ ও সুস্থ শরীর ছাড়া মনের
সুস্থতা আসে না, দেহ ও মন সুস্থ থাকলেই যোগাভ্যাস করা সম্ভব। সে-কারণেই যোগশাস্ত্রে
বিভিন্ন আসনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে সুস্থ ও নিরোগ দেহ চিত্তের আত্মা সাক্ষাৎকারের
পথে সাধকের কোন বাধা সঞ্চার না করে।
আসন
সাধনের ফলাফলঃ আসন
জয় হলে শীত-গ্রীষ্মাদি দ্বন্দ্ব থাকে না। আসন শিক্ষা করার সময় কিছুটা কষ্টকর মনে হলেও
অভ্যস্ত হবার পর তা আর ক্লেশজনক বলে উপলব্ধি হয় না।
(ঘ) প্রণায়ামঃ স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের
গতিরোগ করাকে প্রাণায়াম বলে। প্রাণায়াম তিন প্রকার। যথা- বাহ্যবৃত্তি, আভ্যন্তরবৃত্তি এবং স্তম্ভবৃত্তি।
শ্বাস পরিত্যাগ করে তাকে বাইরে স্থাপন করার নাম বাহ্যবৃত্তি। এই বাহ্যবৃত্তির অপর নাম
রেচক। শ্বাস গ্রহণ করে তখনই না ফেলে তাকে ভেতরে ধারণ করার নাম আভ্যন্তরবৃত্তি। এর অপর
নাম পূরক। রেচক বা পূরক না করে প্রাণবায়ুকে অভ্যন্তরে রূদ্ধ করার নাম স্তম্ভবৃত্তি।
এরই অপর নাম কুম্ভক। পূর্ণ কুম্ভে যেমন জল নিশ্চয় থাকে, নড়াচড়া করে না, সেইরূপ শরীরের
অভ্যন্তরে যখন প্রাণবায়ুর দ্বারা পূর্ণ হয়, তখন সেই প্রাণবায়ুও নিশ্চয় থাকে, সেই কারণে
স্তম্ভবৃত্তির নাম কুম্ভক। প্রাণবায়ু আবার দু’প্রকার- দীর্ঘ ও সূক্ষ্ম। দেশ, কাল ও
সংখ্যার দ্বারা প্রাণায়ামের দীর্ঘতা ও সূক্ষ্মতা জানা যায়। পরিত্যক্ত বায়ু যদি অধিক
দূর যায়, তাহলে তা হবে দীর্ঘ, নতুবা সূক্ষ্ম। যদি আভ্যন্তর বৃত্তিকালে শরীরাভ্যন্তরের
সর্বস্থান বায়ুপূর্ণ হয় বলে অনুভূত হয়, তবে তা হবে দীর্ঘ, নতুবা সূক্ষ্ম। আভ্যন্তর
বৃত্তির দীর্ঘতা ও বাহ্যবৃত্তির সূক্ষ্মতা ভাল। গুরুর উপদেশানুযায়ী এই প্রাণায়াম শিক্ষা
করা উচিত নতুবা নানা প্রকার রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে।
প্রাণায়াম
সাধনের ফলাফলঃ প্রাণায়াম
অভ্যাস করলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াশক্তি বর্ধিত হয় এবং তার ফলে চিত্তের একাগ্রতা শক্তি
বাড়ে, যার জন্য স্থির ও অচঞ্চলভাবে কোন বিষয়ে মন নিবিষ্ট করা সম্ভব হয়। প্রাণায়ামের
ফলে যোগের অন্তরঙ্গ সাধনে যোগ্যতা হয়।
(ঙ) প্রত্যাহারঃ ইন্দ্রিয়গুলিকে বাহ্য
বিষয় থেকে প্রতিনিবৃত্ত করে চিত্তের অনুগত করাই হল প্রত্যাহার। যখন ইন্দ্রিয়গুলি চিত্তের
দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন ইন্দ্রিয়গুলি বিষয়ের প্রতি ধাবিত না হয়ে চিত্তের নির্দেশ
মেনে চলে। প্রত্যেক ইন্দ্রিয় তখন নিজ নিজ বিষয় পরিত্যাগ করে চিত্তের অনুগত হয়। চক্ষু,
কর্ণ, জিহ্বা, নাসিকা ও ত্বক যখন যথাক্রমে রূপ, শব্দ, স্বাদ, গন্ধ এবং স্পর্শ
এর প্রতি ধাবিত হয় এবং সেইগুলির প্রতি আসক্ত হয়, তখন ইন্দ্রিয়গুলির বাহ্যমুখিতা
নষ্ট হলে চিত্ত স্থির ও অচঞ্চলভাবে ধ্যেয় বস্তুতে নিবিষ্ট হতে পারে। ইন্দ্রিয়গুলিকে
বিষয় থেকে নিবৃত্ত করা কষ্টসাধ্য।
প্রত্যাহর
সাধনের ফলাফলঃ তবে
দৃঢ় সঙ্কল্প ও দীর্ঘ অনুশীলনের সাহায্যে ইন্দ্রিয়গুলির উপর প্রভুত্ত্ব অর্জন করা সম্ভব
।
(চ) ধারণাঃ বাহ্য বা অভ্যন্তর যে- কোন অভীষ্ট
বস্তুতে চিত্ত নিবিষ্ট করার নাম ধারণা। বাহ্য কোন বস্তু, ধরা যাক- কোন দেবতামূর্তি
ধারণার বিষয় হতে পারে।
ধারণা
সাধনের ফলাফলঃ নাসাগ্রে,
ভ্রূমধ্যে, হৃদপদ্মমধ্যে কিংবা নাড়ী চক্রেও দীর্ঘকাল ধরে চিত্তকে ধ্যান করা যেতে পারে।
(ছ) ধ্যানঃ যে বিষয়ে চিত্ত নিবিষ্ট হয়, সেই বিষয়ে যদি চিত্তের
একতানতা জন্মায় তাহলে তাকে ধ্যান বলে। একতানতার অর্থ অবিরতভাবে চিন্তা করতে থাকা।
ধ্যান
সাধনের ফলাফলঃ এই অবস্থায় বস্তুর জ্ঞান নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহাকারে
চলতে থাকে। তৈলধারা আর বিন্দু বিন্দু জলের ধারা এই দুই উপমার সাহায্যে ধারণা ও ধ্যানের
পার্থক্য দেখান যেতে পারে। ধারণার প্রত্যয় তৈলধারার মতো। জলবিন্দু ধারার মধ্যে প্রবাহ
লক্ষ্য করা গেলেও জলবিন্দুগুলি বিভিন্ন বা পৃথক, কিন্তু তৈলধারার মধ্যে প্রবাহের অবিচ্ছিন্নতা
লক্ষ্য করা যায়। একই বিষয় সম্পর্কে চিন্তা হলেও ধারণার ক্ষেত্রে খণ্ড খণ্ড জ্ঞানের
আবির্ভাব ঘটে, আর ধ্যানের ক্ষেত্রে জ্ঞানের বিষয় অবিরত ধারায় অবিচ্ছিন্ন প্রবাহের মতো
চলতে থাকে। এর ফলে প্রথমতঃ ধ্যেয় বিষয়ের খুঁটিনাটি জ্ঞান জন্মায় এবং পরে ধ্যেয় বিষয়
একটি সামগ্রিক জীবন্ত সত্তারূপে প্রতীয়মান হয়।
(জ) সমাধিঃ ধ্যান যখন গাঢ় হয়, তখন ধ্যানের বিষয়ে চিত্ত এমন
ভাবে নিবিষ্ট হয়ে পড়ে যে, চিত্ত ধ্যানের বিষয়ে লীন হয়ে যায়। এমন কি ‘আমি যে
ধ্যান করছি’- এই ধারণাও লুপ্ত হয়ে যায়। এই অবস্থায় ধ্যানরূপ প্রক্রিয়া এবং
ধ্যানের বিষয়- এই উভয়ের ভেদজ্ঞান লুপ্ত হয়। ধ্যানক্রিয়া, ধ্যানের বিষয় এবং ধ্যানকর্তা
সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ধ্যেয় বিষয় ছাড়া তখন অন্য কোন বিষয়ের আর জ্ঞান থাকে
না। চিত্ত ধ্যেয় বস্তুর চিন্তায় এমনভাবে নিমগ্ন থাকে যে ধ্যানকর্তা এবং ধ্যানক্রিয়া
বিস্মৃত হয়। চিত্তের এই জাতীয় অবস্থার নামই সমাধি।
ইতিপূর্বে চিত্তবৃত্তি নিরোধরূপে
যে যোগ বা সমাধির কথা বলা হয়েছে এবং অঙ্গরূপে বর্তমানে যে সমাধির কথা বলা হচ্ছে, উভয়ের
মধ্যে পার্থক্য আছে। চিত্তবৃত্তি নিরোধরূপ যে সমাধি তা লক্ষ্য এবং যোগের অঙ্গরূপে যে
সমাধির কথা বলা হল সেটি লক্ষ্য লাভ করার উপায়।
পূর্বোক্ত অষ্টাঙ্গ যোগের প্রথম
পাঁচটি, যথা- যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম ও প্রত্যাহারকে যোগের বহিরাঙ্গ সাধন বলে,
অবশিষ্ট অর্থাৎ ধারণা, ধ্যান ও সমাধিকে অন্তরঙ্গ সাধন বলে।
এই বিষয়ে ধারণা, ধ্যান ও সমাধি-
এই তিনটিকে প্রয়োগ করার নাম সংযম। সংযম কার্যটি বিনা ক্লেশে সাধিত হলে সংযম সিদ্ধি
হয়েছে এইরূপ ধারণা করতে হবে। সংযম সিদ্ধি হলে প্রজ্ঞালোক হয়। সংযম অভ্যাস করার সময়
যোগী প্রথমে স্থূল বিষয়ে সংযম প্রয়োগ করবেন। তারপর সেইগুলি আয়ত্ত হলে সূক্ষ্ম বিষয়ে
সংযম প্রয়োগ করতে হবে। স্থূল বিষয়ে সমাহিত না হয়ে সূক্ষ্ম বিষয়ে সমাহিত হওয়া যায় না।
অর্থাৎ প্রথমে নিম্নভূমিতে, ক্রমশঃ ধীরে ধীরে উচ্চ ভূমিতে সংযম প্রয়োগ করতে হবে। যোগসাধনার
মাধ্যমে যোগীরা নানাপ্রকার অলৌকিক শক্তি ও বিভূতির অধিকারী হন। তাঁরা সূক্ষ্ম, ব্যবহিত
অর্থাৎ কিছু ব্যবধানে অবস্থিত, বিপ্রকৃষ্ট অর্থাৎ দূরে অবস্থিত এবং ভূত, ভবিষ্যৎ ও
বর্তমান সব জানতে পারেন। তাঁরা হিংস্র পশুকে পোষ মানাতে পারেন, সকল কিছুকে বশীভূত করতে
পারেন। ইচ্ছামাত্রই ঈপ্সিত বস্তু লাভ করতে পারেন। তাঁরা দিব্য শব্দ গ্রহণ করতে পারেন,
ইচ্ছামত দিব্যরূপ দেখতে পান, দিব্য রস সমূহের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন। তাঁরা ইচ্ছা
মত যে- কোন স্থানে আবির্ভূত হতে পারেন, বদ্ধ দ্বারের মধ্যে দিয়ে গমন করতে পারেন। যোগাভ্যাসের
দ্বারা এই সব শক্তিলাভ সম্ভব হলেও এই সব সিদ্ধি কৈবল্য লাভের পক্ষে বিঘ্ন বা প্রতিবন্ধকস্বরূপ।
গন্তব্য স্থানে পৌঁছবার পূর্বে পথের মধ্যে কোন বিষয়ে আকৃষ্ট হয়ে আটকে থাকা যেমন বিড়ম্বনা,
তেমনি সাধনের উদ্দেশ্য যে মোক্ষ, সেই লক্ষ্যে উপনীত হবার পূর্বে তুচ্ছ সিদ্ধি নিয়ে
আটক থাকাও তদ্রুপ। বস্তুতঃ এই জাতীয় সিদ্ধির আবির্ভাব যোগীর সমাধিকে আর দৃঢ় থাকতে দেয়
না। কাজেই এই সিদ্ধি সব মোক্ষের বিঘ্নকারী এবং সমাধিনাশক। এইগুলিকে সমাধির উপসর্গ বা
উপদ্রব বলেই গণ্য করা হয়। যোগীকে অবশ্যই এই সব অলৌকিক শক্তি লাভের প্রলোভন থেকে মুক্ত
হয়ে কৈবল্য বা মোক্ষলাভের জন্য যোগসাধনে ব্রতী হতে হবে। যোগের লক্ষণ হল আত্ম-সাক্ষাৎকারে,
যোগী যেন কখনও এই লক্ষ্যভ্রষ্ট না হন।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এই সারকথা
উপনীত হয় যে, যারা কৈবল্য বা মোক্ষলাভের জন্য আগ্রহী তাঁরা অবশ্যই উপকৃত হবেন বলে দৃঢ়
বিশ্বাস।
(সংকলন-যোগসূত্র)
0 comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.