একাদশী ব্রতের মাহাত্ম্য
কোটিরথ ও রাণী সুপ্রজ্ঞা দেবীঃ একাদা
পুরাকালে রাজা কোটিরথ ও রাণী সুপ্রজ্ঞা দেবী ধর্মনিষ্ঠাপরায়ণ সর্বসদ্গুণসম্পন্ন দম্পতি
ছিলেন। তাঁরা জাতিস্মর ছিলেন। এই দম্পতি একাদশীব্রতের দিনে জল পর্যন্ত গ্রহণ না করে
শ্রীহরির পূজা কীর্তন-ভজনে দিবারাত্রি অতিবাহিত করে থাকতেন।
একদিন শ্রীহরি-বাসরে শৌরি নামে
একজন তত্ত্বজ্ঞ, ধর্মাচারণ-ব্রাহ্মণ এসে উপস্থিত হলেন। এই রাজদম্পতি উভয়ই শ্রদ্ধাপূর্বক
তাকে প্রণাম করলেন এবং ভক্তিসহকারে আসনে বসালেন। ব্রাহ্মণ এ রাজদম্পতি সহ বহু ব্রতীকে
দেখে অত্যন্ত খুশি হয়ে প্রশ্ন করলেন- হে রাজন্! আপনারা উভয়েই পারর্মাথিক ধনে ধন্য।
এই জগতে আপনাদের মতো পরম বৈষ্ণব দুর্লভ। আপনাদের এরকম বুদ্ধি কিভাবে জাগ্ররত হল? এ
প্রশ্নের উত্তরে রাণী সুপ্রজ্ঞা দেবী বললেন- আমারা পূর্ব জন্মে মহাপাতকী ছিলাম। কিন্তু
একাদশীর প্রভাবে যমদণ্ড থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। সেই স্মৃতির প্রভাবে আমরা উভয়েই শ্রীহরির
অক্ষয় ধাম লাভের জন্য একাদশী ব্রত অনুষ্ঠান পালন করছি।
এ তত্ত্বজ্ঞ ব্রাহ্মণ বললেন-
“যদি আপনি আপনার পূর্ব জন্মের কথা স্মরণ করতে পারেন, তাহলে আমাকে কৃপা করে একথা বিস্তারিত
ভাবে বলুন”।
সুপ্রজ্ঞা দেবী বললেন- যদিও এ
কথা অপ্রকাশ্য, তবুও আপনি পরম বৈষ্ণব বিধায় আপনার কাছে বর্ণনা করছি। আমি পূর্ব জন্মে
চিত্রপদা নামে একজন বারবণিতা ছিলাম এবং বহু পাপকার্য করেছিলাম। আর এই রাজা নিত্যোদয়
নামে একজন শূদ্র ছিলেন এবং জ্ঞাতিবন্ধুরা তাকে নানা অনাচারের জন্য পরিত্যাগ করলে তারপরে
তিনি আমার আশ্রয়ে থাকতে লাগলেন। আমরা দুজনই স্বামী-স্ত্রীর মতোই জীবন-যাপন করতেন লাগলাম।
একদিন মারাত্মক অসুখে পড়লাম এবং গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। এ জ্বরে কাতর হয়ে দিনরাত হে গোবিন্দ!
হে হরি! হে নারায়ণ! আমাকে রক্ষা করো- বলে কাঁদতে লাগলাম এবং সারারাত্র ঘিয়ের প্রদীপ
জ্বালিয়ে জেগে রইলাম। সারাদিন কোনও কিছু আহার-বিহার করিনি, জলও গ্রহন করিনি। আমার এরূপ
অবস্থা দেখে তিনিও আহার-বিহার গ্রহন না করে, না ঘুমিয়ে আমার কাছে বসে শ্রীহরিকে ডাকতে
লাগলেন।
পরের দিন সূর্যোদয় কালে আমার
মৃত্যু হয়। তারপরে তিনিও অতি মৃত্যুশোকে কাতর হয়ে দেহত্যাগ করলেন। মৃত্যুর পর বিকট
ভয়ংকার যমদূতেরা এসে আমাদের দু’জনকে খুব শক্ত
করে বেঁধে দুর্গম পথে যমপুরীতে নিয়ে গেলেন।
সেখানে যমরাজ আমাদের পাপ-পুণ্যের
বৃত্তান্ত জানতে চিত্রগুপ্তকে নির্দেশ করলেন। চিত্রগুপ্ত বললেন- “তাঁরা অত্যন্ত মহাপাপী
হলেও একাদশীর উপবাস একদিন করেছে। তাই তাঁরা সর্বপাপ হইতে মুক্ত হয়েছে”।
একাদশী ব্রত সম্পর্কে কিছুই না
জেনেও আমরা নির্জলা উপবাস থেকে রাত্রি জাগরণ এবং শ্রীহরির নাম করেই দ্বাদশীতে দেহ ত্যাগ
করেছিলাম। সেটাই আমাদের জীবনের পরম সৌভাগ্য ছিল।
একথা শুনে জানতে পারলাম আমাদের
নাকি ভগবদ্ধামে গতি হবে। চিত্রগুপ্তের একথা শুনেই যমরাজ তৎক্ষণাৎ নানা সুগন্ধি পুষ্প,
চন্দন, বস্ত্র, অলংকার, সুস্বাদু-ভোজ্য দ্রব্য আমাদের প্রদান করে একটি রথের উপরে বসালেন
এবং বললেন- “আপনারা এখন বৈকুন্ঠে চলুন”।
অপ্রত্যাশিতভাবে যমরাজের এরূপ
আচরণ দেখে আমরা অত্যন্ত বিস্মিত হলাম। তখন আমাদের দেখতে ইচ্ছা হল, যে কিভাবে যমপুরীতে
পাপীদেরকে শাস্তি ভোগ করতে হয়। তখন আমাদের কৌতুহল দেখে যমরাজ রথে চড়িয়ে নরককুণ্ডে পাপীদেরকে
দেখতে পাঠালেন। সেই সব ভয়ংকর নরককুণ্ডের দৃশ্য দেখলাম এবং অত্যন্ত ভয়ে ভীত হলাম।
পন্ডিত ব্রাহ্মণ শৌরি বললেন-
“আপনারা সেখানে পাপীদের যে সব দুর্দশা দেখলেন তা দয়া পূর্বক আমাকে বলুন”।
সুপ্রজ্ঞা দেবী দুঃখিত চিত্তে
বলতে লাগলেন- সেখানে বিশাল একটি দুর্গম অতি দুঃখপ্রদ রাস্তা আছে। সেই রাস্তায় কোথাও
জ্বলন্ত আগুন, কোথাও উত্তপ্ত কাঁদা, কোথাও অন্ধকূপ, কোথাও কাঁটাময় বৃক্ষ, কোথাও কঙ্কালের
স্তূপ, কোথাও ভয়ংকর জন্তুর গর্জন। সেই ক্লেশপূর্ণ পথ দিয়ে যমদূতেরা পাপীদেরকে টেনে
টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পাপীদেরকে কারও গলায়, কারও কানে, কারও অঙ্কুশ দিয়ে প্রহার করা হচ্ছে,
কারও কান ছিদ্র করে ভারী পাথর ঝুলিয়ে, কারও শিশ্নতে লোহা বেঁধে, ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে,
কারও মাথা নিচু করে পা উপরে খাঁড়া করে নিয়ে যাচ্ছে। এইভাবে যমপুরীতে পাপীরা মারা যাচ্ছে,
সেখানে ভয়ংকর রূপ ধরে যমরাজ সেইসব পাপীদেরকে ধমক দিয়ে বললেন-“তোমরা মূর্খ, আমাকে অগ্রাহ্য
করে জগতে নানা দুরাচারে রত থেকেছো, এখন তোমরা পাপের উপযুক্ত দণ্ড লাভ কর”। পাপীদেরকে
সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে চিত্রগুপ্ত প্রত্যেকের পাপকর্মের কথা বলতে থাকেন। তখন পাপীরা
মাঝে মাঝে অভিযোগ করে- “আমি এতো পাপ করেছি কি করে বলছেন?” তখন যমরাজের আহ্বানে সূর্য,
চন্দ্র, বায়ু, আকাশ, পৃথিবী, জল, তিথি, দিবা, রাত্রি, ঊষা, সন্ধ্যা, ধর্ম- ইত্যাদি
বহু সাক্ষী এসে পাপীদের পাপ কর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
ভীষণ নিষ্ঠুর যমদূতেরা পাপীদের
বিচারের পর নরককুণ্ডের মধ্যে নিয়ে যায়। কাউকে বিষ্ঠার গর্তে, কাউকে তপ্তকূপে, কাউকে
কাঁটার গর্তে নিক্ষেপ করে। কেউ নিজ মাংস ভক্ষণ, কেউ মলমূত্র ভক্ষণ, কেউ শুক্র বা রক্তপান
করতে থাকে। কাউকে পা বেঁধে মাথাটিকে পাথরের উপর আছাড় দেওয়া হয়। বঁড়শির কাঁটা দিয়ে কারও
চোখ উৎপাটন করা হচ্ছে। কাউকে গাছের ডালে বেঁধে আগুন ধরানো হচ্ছে। কাউকে বিষাক্ত ধূমপান
করানো হচ্ছে। কাউকে তপ্ত স্থানে শুইয়ে দিয়ে ভারী পাথর বুকের উপর চাপা দেওয়া হচ্চে।
কাউকে উত্তপ্ত তেলের কড়াঁইতে ভাঁজা হচ্ছে, কাউকে বাঘ-ভালুকের খাবারের জন্য ঠেলে দেওয়া
হচ্ছে। কাউকে কৃমি ভক্ষণ, দুর্গন্ধ মাংস ভক্ষণ করতে দেওয়া হচ্ছে। কাউকে নাকের মধ্যে
কাপড় ঢুকিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করা হচ্ছে।
এইভাবে পাপীরা নরক যন্ত্রণা ভোগ
করে এবং যন্ত্রণায় কাতর হয়ে “ত্রাহি ত্রাহি” করতে থাকে। দীর্ঘকাল ধরে পাপীরা ক্ষুধা
তৃষ্ণায় কাতর হয়ে সমস্ত পাপকর্মের ফল ভোগ করতে থাকে। অবশেষে পাপীদেরকে একটি পাপযোনিতে
জন্মগ্রহনের জন্য পাঠানো হয়।
এইরূপে পাপীদের দুর্গতি দর্শন
করে আমরা দু’জনে রথে চড়ে ভগবদ্ধামে গমন করি। কোটি কল্পকাল সেখানে পরম আনন্দে বাস করে
অখিল সম্পদ ভোগ করলাম।
কিন্তু যে একাদশীর কৃপায় আমরা
অপ্রত্যাশিতভাবে এমন সৌভাগ্য প্রাপ্ত হয়েছি, সেই একাদশীর মাহাত্ম্য জগতে প্রচার করতে
আমাদের অভিলাষ হল। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণুর প্রেরণায় আমরা এই ধরাধামে রাজবংশে জন্মগ্রহণ
করেছি। এই জন্মে একাদশী ব্রত আচারণ ও তার মাহাত্ম্য প্রচার করে সুখ-মৃত্যু লাভ করে
শ্রীহরির বৈকুন্ঠ ধামে গমন করব।
==বাংলাদেশ সেবাশ্রম==
0 comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.