ভগবানের কৃপা ভিন্ন মায়াত্যাগ
হয় না
প্রত্যেক জীবই পূর্বজন্ম-সংস্কারজাত স্বভাবানুসারে
স্বীয় স্বীয় কর্মে আবদ্ধ আছে, তাহাকে অবশভাবেই সেই কর্ম করিতে হয়। সাংখ্যশাস্ত্রের
পরিভাষায় বলা হয় প্রকৃতিই সেই কর্ম করান। বেদান্ত ও ভক্তি-শাস্ত্রে বলা হয় অন্তর্যামী
বা ঈশ্বরই মায়ার দ্বারা সেই কর্ম করান।
শ্রীভগবান্ বলিতেছেন- তুমি ইচ্ছা না করিলেও প্রকৃতি
তোমাকে স্বাভাবিক কর্মে প্রবর্তিত করিবে, তোমাকে অবশভাবেই সে কর্ম করিতে হইবে। অন্যত্রও
আছে,-‘প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি’ (৩/৩৩ শ্লোক)। প্রকৃতির প্রেরণায় কর্ম, কর্মফলে সদসৎ যোনিতে
জন্ম, জন্মিয়া আবার কর্ম, কর্মফলে আবার জন্ম।
সুতরাং দেখা যায়, জীবকে অবিরত জন্ম-কর্মের ভবচক্রেই
ঘুরিতে হয়। এই প্রকৃতি-পারতন্ত্র্য বা কর্মবিপাক হইতে মুক্তিলাভের উপায় কি? জ্ঞানলাভার্থ,
মোক্ষার্থ জীবের কি কোন স্বাতন্ত্র্য নাই। অধ্যাত্মশাস্ত্র বলেন, আছে। পরমাত্মা শুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব
এবং তিনিই বা তাঁহারই সনাতন অংশ জীবাত্মরূপে দেহে আছেন; তিনি কখনও প্রকৃতির পরতন্ত্র
হইতে পারেন না। দেহেন্দ্রিয়াদির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় তাঁহাকে বদ্ধ ও পরাধীনের ন্যায়
বোধ হয়; তিনি মায়াধীন হন। কিন্তু তাহা হইলেও স্বতঃই তাঁহার মুক্ত হইবার প্রেরণা আসে।
গুরূপদেশ, সাধুসঙ্গ প্রভৃতি অনুকূল অবস্থায় সেই প্রেরণা মন এবং বুদ্ধির উপর কার্য করে,
তাহাতেই মনুষ্যের মনে আত্মোন্নতি বা মোক্ষানুকূল কর্ম করিবার প্রবৃত্তি জন্মে। কথাটা
অন্যভাবেও বুঝান যায়। আমাদের মধ্যে দুইটি ‘আমি’ আছে। একটি- কাঁচা আমি, বদ্ধ আমি, অহঙ্কারী আমি,
প্রকৃতির দাস আমি (Lower-self,
ego-sense); আর একটি-পাকা ‘আমি’, শুদ্ধ, বুদ্ধ স্বতন্ত্র ‘আমি’ (Higher self, soul)। এই পাকা ‘আমি’ দ্বারা কাঁচা
‘আমি’ উদ্ধার করিতে হইবে, (গীতা-৬/৫-৬ শ্লোকে) ‘উদ্ধরেদাত্মনাত্মানম্’ ইত্যাদি কথার মর্ম ইহাই। এই গেল জ্ঞানমার্গের কথা।
কিন্তু ভক্তিমার্গে বলা হয় যে, শ্রীভগবান্ই অন্তর্যামিরূপে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত থাকিয়া
জীবকে যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার ন্যায় মায়া দ্বারা চালাইতেছেন, সুতারাং সর্বতোভাবে তাঁহার
শরণ লইলেই তাঁহার প্রসাদে মুক্তিলাভ হয় (গীতা-৮/২২, ১০/১০, ১৮/৬১-৬২ শ্লোকে)। ইহাই কৃপাবাদ। মনে রাখা প্রয়োজন, কৃপাবাদ অর্খ নিশ্চেষ্টতা নয়, আত্মচেষ্টা
ব্যতীত ভগবৎকৃপা হয় না, “ন ঋতে শ্রান্তস্য সখ্যায়
দেবাঃ” (ঋক্ ৪/৩৩/২১ শ্লোকে)-নিজে শ্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত
দেবতারাও সাহায্য করেন না।
পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ ইচ্ছা-স্বাতন্ত্র্য (Freedom of the Will) সম্বন্ধে অনেক গবেষণা করিয়াছেন,
কিন্তু কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারিয়াছেন বলিয়া বোধ হয় না। আর্য ঋষিগণ সাংখ্য-বেদান্তাদি
শাস্ত্রে মনস্তত্ত্ব ও আত্মতত্ত্বের যে সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করিয়াছেন তাহা পর্যালোচনা
করিলে দেখা যায় যে, ‘ইচ্ছা-স্বাতন্ত্র্য’ শব্দটিই একরূপ অর্থহীন। কারণ, ইচ্ছা মনের ধর্ম;
মন বুদ্ধির দ্বারা চালিত হয়, মনবুদ্ধি প্রকৃতিরই পরিণাম এবং প্রকৃতির গুণানুসারেই বিভিন্ন
হয়, সুতরাং ইচ্ছাও সর্বদাই প্রকৃতির অধীন- উহার স্বাতন্ত্র্য নাই। উহার স্বাতন্ত্র্য
তখনই হয়, যখন জীব ‘ত্রিগুণাতীত বা নিত্যসত্ত্বস্থ’ হয়, অর্থাৎ জীবের স্বাতন্ত্র্য-ইচ্ছা থাকে না, যখন
জীবের ইচ্ছা এবং ঈশ্বরেচ্ছা এক হইয়া যায়-প্রকৃতপক্ষে উহা ‘আত্ম-স্বাতন্ত্র্য’, ‘ইচ্ছা-স্বাতন্ত্র্য’ নহে। এই হেতুই গীতায় ‘মিশ্র-সাত্ত্বিক’ বুদ্ধিকেও বন্ধনের কারণই বলা হইয়াছে।
“জয় রাধেশ্যাম”
==বাংলাদেশ সেবাশ্রম==
0 comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.