শ্রী শ্রীমৎ আচার্য্য বিবেকানন্দ গোস্বামীর আত্মজীবনীঃ
শ্রী শ্রীমৎ আচার্য্য বিবেকানন্দ গোস্বামীর আত্মজীবনীঃ আদর্শ স্থানীয় উচ্চাধিকারী ক্ষণ
জন্মা মানবের মধ্যে, একটি শ্রেণী মনুষ্য-জন্মের ক্রম বিকাশের ফলে উর্ধ্বে উঠিয়া
ভাগবত ভাব লাভ করেন। অন্য আর একটি শ্রেণী ভাগবতের ভাষায় এরা “গুঢ় কপট মানুষ”
অর্থাৎ এরা প্রকৃত পক্ষে মানুষ নহেন; জীব প্রেম বশত: ভগবান মানবীয়তার মধ্যে নামিয়া
আসেন্; নরদেহ ধারণ করেন। ভক্তের সাথে মিলে মিশে আনন্দ পান, উন্নত জীবনের আচরণ করে
আদর্শ সৃষ্টি করেন, উদ্ধারের পথ প্রদর্শন করেন। এরা সাধারণত: ঈশ্বরীয় ক্ষমতা বা
ঐশ্বর্য্য প্রদর্শন খুব কম করেন, আত্মগোপন তাঁহার লীলার কৌশল। যিনি পূর্ণ তাঁহার
অপূর্ণরূপে আবির্ভাব, যিনি মহান তাঁহার ক্ষুদ্রত্বের অভিমান, যিনি শক্তিমান তাঁহার
দুর্বলতার লীলা। অঘটন-ঘটন পটিয়সী যোগমায়া অবলম্বন করে তিনি ভক্তগণের সাহায্য
সহযোগিতা করেন। তিনি সাধারণত: ধরা দেন না। ভক্তগণকে আগাইয়া নিতে মাঝে মধ্যে ধরা
দেন বটে, তবে লুকোচুরিও করেন। আন-লোক অর্থাৎ অপরলোক থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন,
ব্যবহারের বৈপরিত্যও দেখা যায়। এরা জগতে ভগবানের ইচ্ছা বা জ্ঞানেরই অনুসরণ
পুন:প্রবর্তন করার জন্য আধ্যাত্মিক গুরু বা ত্রানকর্তারূপে আবির্ভূত হন। শাস্ত্রে
এদেরকে অবতারও বলা হয়। শ্রীমৎ আচার্য্য বিবেকানন্দ গোস্বামী এই শ্রেণীর একজন
জগৎ-গুরু। বাল্যে এই শিশুর আচার-আচারণ ভাব-ভঙ্গী দেখে হিন্দু, মুসলমান, নারী-পুরুষ
সকলেই বলিতেন, “ বিকেক জন্মিবার পর সাধু হয়নি; সিদ্ধ সাধু হয়েই জন্মেছে। চাঁদে
কলঙ্ক থাকলেও, বিকেকের কোন কলঙ্ক নাই”।
বাংলা
১৩৪৭ সালে (১৯৪০ খ্রী) ভাদ্র মাসে রাধাষ্টমী তিথিতে বাগেরহাট জেলার চিতলমারী থানা নিকটস্থ
খড়মখালী গ্রামে মাতুলালয় রাত্র দ্বিপ্রহরের পর জন্ম গ্রহন করেন এই অবতার শিশু। তার
পিতার নাম শ্রী যতীন্দ্র নাথ গোস্বামী এবং মাতার নাম শ্রী মতি তারা দেবী। রাত্রটি
ছিল অত্যন্ত দূর্যোগপূর্ণ। এলাকাটি ছিল জলে প্লাবিত। মাঠ-ঘাট, উঠান-বাড়ী ছিল জলে
ডুবু ডুবু। শিয়াল, সাপ, পেঁচা ইত্যাদি বিভিন্ন জীব আশ্রয় নিয়া ছিল আতুর ঘরে। পরদিন
সুখবর ছড়িয়ে পরলে অপ্রত্যাশিত ভাবে বহু সাধু মহাজনের আগমন ঘটে ঐ বাড়ী। গুরুদেবের
দাদুভাই এবং বাবা উভয়ই ময়রা দোকানী, তাই ঘটা করেই করা হয় মিষ্টি মুখ। ননী চোরাও
বঞ্চিত হয়নি ক্ষীর ননী হতে। বিবেকানন্দ গোস্বামী বাল্যকাল থেকেই সব সময় কর্মরত
থাকতেন। কর্মই ছিল তাঁহার ধর্ম। শৈশবকাল হতেই তিনি কাজ পছন্দ করতেন। নিজস্ব কাজ না
থাকলে প্রতিবেশীর কাজ করতেন। এলাকার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে তিনি যথা সম্ভব পরিশ্রম
ও সাধু-মহাজনদের সেবা যত্ন করতেন।
১৯৫৭
খ্রীষ্টাব্দে তিনি চিতলমারী উপজেলার চরবানিয়ারী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে
প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বাগেরহাটের পি.সি.কলেজ থেকে আই.এ ও বি.এ পাশ
করেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে তিনি এম.এ ডিগ্রী লাভ
করেন। সংস্কৃত কলেজে নিয়মিত অধ্যায়ন করে সপ্ততীর্থ উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি বাংলা ও
সংস্কৃত বিষয়েও এম.এ পাশ করেন এবং তাঁহার ৩২ খানা সার্টিফিকেট ছিল। কর্মজীবনে
মাটিভাঙ্গা কলেজ, মঠবাড়ীয়া সরকারী কলেজ ও বরগুনা সরকারী কলেজ হইতে অবসর গ্রহন
করেন। হিন্দু-মুসলিম তাঁহার গুণমুগ্ধ ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা অগণিত। প্রত্যেকেই এই
স্যারের গুণকীর্তনে পঞ্চমুখ। চরিত্রবান, ঈশ্বরপ্রেমী, নিরভিমানী, সহজ-সরল, অলৌকিক
শক্তি সম্পন্ন এই মানুষটির গুণে মুগ্ধ হয়ে মানুষ তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহন শুরু করেন।
অল্প দিনেই তাঁহার কীর্তি, যশ ও সুনাম ছড়িয়ে পড়ায়, শিষ্যের সংখ্যা ধারণাতীত ভাবে
বৃদ্ধি পায়। বিবেক ভক্তরা বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ ও ভারতে
এর সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশটির মত। সরলতা, সত্যবাদিতা, ধার্মিকতা, নিয়মানুবর্তিতা, মিতব্যয়িতা,
সাম্যবাদ, জীবপ্রেম ইত্যাদি হাজারো মানবীয়গুণের সমাবেশ তাঁহার জীবনে এর প্রত্যেকটি
বিষয়ের উপর বহুগ্রন্থ রচিত হবে সন্দেহ নাই। তাই বিবেকানন্দের জীবনীর সব কথার শেষ
কোন দিন হইবে না; অসমাপ্তই থাকিয়া যাইবে।
আধ্যাত্মবাদীদের
মতে, গীতা ধর্মই ছিল তাঁহার মতাদর্শ। স্বধর্মানুসারে যথা প্রাপ্ত কর্ম ভগবানের কর্ম
মনে করিয়া পরোপকার ও পরহিতের নিমিত্ত নিরলস ভাবে স্বচ্ছ ভগবৎ জ্ঞান ও উৎকট ভক্তির
সমন্বয় ঘটাইয়া আমৃত্যু সম্পাদন করিয়া গিয়াছেন এই কর্মযোগী। সৃষ্টিকর্তাতে তিনি
স্বামী হিসাবে ভালবাসতেন। তাঁহার প্রেম বা ভালবাসার কোন অংশীদার বা শরীক ছিল না;
সকল কিছু উজার করিয়া দিয়াছেন ভগবত চরণে। পূর্ণ আত্মসমর্পন ছিল তাঁহার নীতিতত্ত্ব।
তিনি ছিলেন কৃষ্ণের আর কৃষ্ণ ছিল তাঁহার। হাতের শাখা, পরিধানে শাড়ী এবং কপালে
সিঁদূরই ইহার যথার্থ প্রমাণ। তাঁহার অগণিত সুভাকাঙক্ষী ও লাখ লাখ ভক্তবৃন্দকে দুঃখ
সাগরে ভাঁসিয়ে ২১-১০-২০১০ ইং তারিখ রাত ৯টায় তিনি মঠবাড়ীয়া মন্দিরে অনুষ্ঠান
চলাকালীন সময়ে স্ব-ধামে প্রত্যাবর্তনের যাত্রা সূচনা করেন এবং এ সংবাদ শুনে ২/৩ জন
তদ্ভাবপ্রাপ্ত মরমী ভক্ত তাঁহার সহযাত্রী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। অবশেষে ঢাকার
স্কয়ার হাসপাতালে ০১-১২-২০১০ ইং তারিখ, সকাল ০৭টা-৩৫মিঃ, বুধবার- তিনি স্ব-ধামে
গমন করেন। আমরা তাঁহার নির্দেশিত পথের অনুসারী হইয়া মানব জীবন সার্থক করিতে চাই।
“জয়
রাধেশ্যাম”
0 comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.